...
রবিবার, মে ১৯, ২০২৪

করোনায় আজান-জামাআত-জুমআ নিয়ে ইসলাম কী বলে?

যা যা মিস করেছেন

প্রাণঘাতি মহামারি করোনাভাইরাস তথা কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ৪ লাখ ৩৪ হাজার ৫৯৫ জন। এতে মারা গেছে ১৯ হাজার ৬০৩ জন। মহামারিতে আক্রান্ত ও মৃতের এ সংখ্যা বেশি নয়। কারণ ইতিহাসে এর চেয়েও ভয়ংকর মহামারি সংঘটিত হয়েছিল। সে সময়ও আজানে পরিবর্তন হয়েছিল বন্ধ হয়েছিল জুমআ। পথে-ঘটে ছিল মানুষের লাশের সারি। ইতিহাসের বড় সে মহামারির নাম ছিল ‘আল-মাউতুল আসওয়াদ বা কালো মড়ক’।

বিশ্বজুড়ে আলাচিত বড় এ মহামারি শুরু হয়েছিল ১৩৪৬ খ্রিষ্টাব্দে। ১০ বছর স্থায়ী হয়েছিল সে মহামারি। তাতে আক্রান্ত হয়ে দামস্কে একদিনে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৭০ হাজারের মতো।

আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, ‘আল-মাউতুল আসওয়াদ’ নামক মহামারির সূচনাও হয়েছিল চীন থেকে। তাতে বর্তমান সময়ের মতো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ইউরোপ। যেমনটি ঘটছে এবারের কোভি-১৯ এ।

করোনাভাইরাসে চীনে আক্রান্ত হয়েছে ৮১ হাজার ২১৮ জন। আর তাতে মারা গেছে ৩ হাজার ২৮১। অথচ ইউরোপের দেশ ইতালি ও স্পেন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। শুধু ইতালিতে আক্রান্তের সংখ্যা ৬৯ হাজার ১৭৬ জন হলেও তাদের দেশে মারা গেছে ৬ হাজার ৮২০ জন। আর স্পেনে আক্রান্তের সংখ্যা ৪৭ হাজার ৬১০ হলে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪৩৪ জনে।

১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দের সে মহামারিতে মিসরের আলেক্সান্ডারে একদিনে মারা গিয়েছিল ২০ হাজার মানুষ। তথ্য প্রযুক্তির এ যুগের মতো সে সময় আধুনিক জরিপ না থাকলে ঐতিহাসিক তথ্য মতে ‘আল-মাউতুল আসওয়াদ’ নামক মহামারিতে সে সময় পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়।

‘আল-মাউতুল আসওয়াদ’ নিয়ে ‘বাযলুল মাউন ফি ফাজলিত তাউন’ নামক একটি বিখ্যাত কিতাব লিখেছেন বিখ্যাত ইসলামিক ব্যক্তিত্ব আল্লামা হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি। সে মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে তার ২ কন্যাও মারা গিয়েছিল।

সুতরাং করোনাভাইস সম্পর্কে সচেতন হওয়া খুবই জরুরি। আর তাতে আজান ও নামাজ আদায়ে অনুসরণ করতে হবে ইসলামের দিক নির্দশনা। যে নির্দেশনা এসেছে বিশ্বনবির হাদিস ও ইসলামিক স্কলারদের বক্তব্যে।

বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহামারির (প্লেগ) কারণে ‘লকডাউন’ ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন-

‘তোমরা যখন কোনো এলাকায় মহামারি প্লেগের বিস্তারের কথা শুনো, তখন সেখানে প্রবেশ করো না। আর যদি কোনো এলাকায় এর প্রাদুর্ভাব নেমে আসে, আর তোমরা সেখানে থাকো, তাহলে সেখান থেকে বেরিয়েও যেও না।’ (বুখারি)

হাদিসের নির্দেশনা মেনে বর্তমান সময়ে মহামারি করোনায় সতর্কতাবশতঃ সবার যেমন এদিক-সেদিক অবাধ যাতায়াত করা কোনোভাবেই ঠিক নয় তেমনি মহামারির সময় নামাজের জামাআত, জুমআ এবং আজানের ব্যাপারেও হাদিসের নির্দেশনা মেনে চলা জরুরি।

ইসলামি শরিয়তে দৃষ্টিতে মহামারি আক্রান্ত অঞ্চলে আজান ও নামাজের ব্যাপারে শরিয়তের নির্দেশনা মানুষকে সুস্পষ্টভাবে জানানো খুবই জরুরি। এ নিয়ে ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টির কোনো সুযোগ নেই।

কেননা দামেস্কের মতো বর্তমানে বাংলাদেশ কিংবা অন্য কোনো দেশে যদি একদিনে ২০ হাজার কিংবা ৭০ হাজার মানুষ মারা যায় তবে তা সামাল দেবে কে?

মহামারি সম্পর্কে ইবনে বতুতার বর্ণনা
বিশ্ববিখ্যাত দেশ ভ্রমণকারী ইবনে বতুতা সাড়ে ৭শ হিজরি সালে সংঘটিত মহামারি ‘আল-মাউতুল আসওয়াদ’ সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন-
‘সে সময় মহামারি আক্রান্ত হয়ে পথে-ঘাটে মানুষের মরা দেহ পড়ে ছিল। আকাশে শকুন দলবদ্ধ হয়ে উড়েছিল। বড় বড় গর্ত করে এসব লাশ দাফন করা হয়েছিল। সে সময় মুসলমানরা কুরআন হাতে পথে বেরিয়ে পড়েছিল। মহামারি আক্রান্ত অঞ্চলে একাধারে তারা ৩দিন রোজা পালন করেছিল ‘

আবার খ্রিস্টনরা বাইবেল হাতে, ইয়াহুদিরা তাওরাত হাতে পথে নেমে এসেছিল। সম্মিলিতভাবে সবাই মহান প্রভুর কাছে মহামারি থেকে মুক্তি প্রার্থণা করেছিল। অবশেষে আল্লাহ তাআলা রহম করেন।

সে কারণে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এক হয়ে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কাজ করা ও ইসলামি শরিয়তের দিকনির্দেশনা মেনে চলে মহামারি থেকে আত্মরক্ষা করা জরুরি। এসব ক্ষেত্রে কোনো বক্তা বা আলোচকের কথা বা ব্যক্তিগত একক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কোনোভাবেই উচিত হবে না।

সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদ, বিশ্বের অনেক বড় বড় ইসলামিক স্কলার ও দাঈগণ নামাজ ও মসজিদে জুমআ ও জামাআতের ব্যাপারে দিয়েছেন দিকনির্দেশনা। অনেকে আবার রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। যা বাংলাদেশের জন্যও অনেক বেশি প্রযোজ্য।

কারণ, উন্নত বিশ্বে প্রচুর চিকিৎসক ও চিকিৎসা সরঞ্জমাদি থাকার পরেও ক্ষমতাধর শক্তিশালী রাষ্ট্র চীন, ইতালি, ইরান, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ এ ভাইরাস প্রতিরোধে বেসামাল। সে তুলনায় প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ ততটা শক্তিশালী নয়।

এ পরিস্থিতিতে মসজিদে নামাজের জামাআত, জুমআ আদায় নিয়ে সরকারি সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কিংবা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে মসজিদে জামাআত ও ব্যাপক উপস্থিতি রোধ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক ও গরম বক্তব্য দেয়া খুবই হাস্যকর ব্যাপার। বরং এ থেকে সাধারণ মানুষকে বুঝানো ও সতর্ক করাই আলেম-ওলামাদের একান্ত দায়িত্ব ও ঈমানি কর্তব্য।

মহামারিতে আজান, জামাআত ও জুমআয় ইসলামের দিক নির্দেশনা
ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে মহামারি আক্রান্ত অঞ্চলে আজান দেয়া, নামাজের জামাআত অনুষ্ঠিত হওয়া কিংবা জুমআ অনুষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে করণীয় কী হতে পারে? এ সব ক্ষেত্রে নির্দেশনাই বা কী?

সম্প্রতি সময়ে সর্ব প্রথম কুয়েতের মসজিদে আজানের শব্দ পরিবর্তন করে ঘরে নামাজ পড়ার কথা বলা হয়েছে। তারপর আরব আমিরত অতপর সৌদি আরও একই পথ অনুসরণ করেছে।

এ দেশগুলো আজানের ‘হাইয়্যা আলাস-সালহ’ এর পরিবর্তে দুইটি শব্দ ব্যবহার করেছে। কেউ বলেছেন- আসালাতু ফি বুয়ুতিকুম, আবার কেউ বলেছে ‘সাল্লু ফি রিহালিকুম’ শব্দগুলোর অর্থ হলো বাড়িতে অবস্থান করে নামাজ পড়ুন।

কুয়েত কিংবা সৌদির আজানের শব্দে এ পরিবর্তন ইসলাম বিরোধী নয় বরং হাদিসের নির্দেশনারই অনুসরণ। এ ব্যাপারে হাদিসের নির্দেশনা হলো-
হজরত নাফি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, প্রচণ্ড এক শীতের রাতে হজরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু যাজনান নামক স্থানে আজান দিলেন। অতপর তিনি ঘোষণা করলেন- صَلُّوا فِي رِحَالِكُمْ
‘সাল্লু ফি রিহালিকুম’ অর্থাৎ তোমরা আবাস স্থলেই নামাজ আদায় করে নাও।’

পরে তিনি আমাদের জানালেন যে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘লাইহি ওয়া সাল্লাম সফরের অবস্থায় বৃষ্টি অথবা তীব্র শীতের রাতে মুয়াজ্জিনকে আজান দিতে বললেন এবং সাথে সাথে এ কথাও ঘোষণা করতে বললেন যে, তোমরা নিজ বাসস্থলে সালাত আদায় কর।’ (বুখারি, মুসলিম, মুসনাদে আহমদ)

সব মাজহাবেই সমস্যার আলোকে আজানের শেষে কিংবা মাঝে শব্দ পরিবর্তন করে হাদিসের অনুসরণে আজান দেয়ায় কোনো সমস্যা নেই।

আবার দুর্যোগের কারণে মসজিদের জামাআতে নামাজ ত্যাগের যেমন অবকাশ আছে তেমনি প্রয়োজনে মসজিদে জুমআ বন্ধ রাখার নির্দেশ আসলেও সেটা পালনে ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে তা অসম্ভব নয়।

আবার হানাফি মাজহাবে জুমআ আদায়ের জন্য যেমন মসজিদ শর্ত নয় আবার বড় জামাআতও শর্ত নয়। ইমাম আবু ইউসুফ রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মতে, ইমাম ছাড়া ২ জন থাকলেই জুমআ আদায় করা যায়।

সুতরাং করোনায় খারাপ পরিস্থিতির শিকার হলে প্রত্যেকেই যার যার বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে জুমআ আদায় করে নিতে পারবেন।

সতর্কতা
মসজিদে নামাজের জামাআত কিংবা জুমআ আদায় নিয়ে এসবই ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখেই বলা। রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘লকডাউন’ কিংবা মসজিদে ব্যাপক উপস্থিতির ব্যাপারে দিকনির্দেশনা আসলে তা পালনই হবে একান্ত জরুরি।

সুতরাং বাংলাদেশে যদি মহামারি করোনা ব্যাপক আকার ধারণ করে কিংরা রাষ্ট্রীয়ভাবে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে কিংবা করোনা প্রতিরোধে আজান, মসজিদে জামাআত কিংবা জুমআ আদায়ের ব্যাপারে কোনো দিকনির্দেশনা দেয়, তা নিয়ে বিতর্ক না করে সরকারের সিদ্ধান্তে সহযোগিতা হবে কল্যাণকর কাজ। আর তা হবে হাদিসের দিক-নির্দেশনারও অনুসরণ।

কেননা মহামারি করোনা যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় আর তা চীন, ইতালি, স্পেন, ইরান, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্রে মতো অবস্থায় গিয়ে দাঁড়ায় তবে তা নিয়ন্ত্রণ করা যেমন দুষ্কর হয়ে যাবে আর তখন সতর্কতা অবলম্বনও কোনো কাজে আসবে না।

সুতরাং আজানের শব্দ পরিবর্তন, মসজিদে জামাআত এবং জুমআ নিয়ে অযথা তর্ক-বিতর্ক নয় বরং মহামারি করোনায় রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত যথাযথ মেনে জনসমাগম এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। আর বেশি বেশি আল্লাহমুখী হওয়া, আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং পাপাচার ও অন্যায় বন্ধ করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসাই মুমিন মুসলমানের একান্ত করণীয় কাজ।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে করোনা প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয় সব সিদ্ধান্তের আলোকে ইসলামের নির্দেশনাগুলো যথাযথ পালনের মাধ্যমে মহামারি থেকে মুক্ত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

অনুমতি ব্যতিত এই সাইটের কোনো কিছু কপি করা কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয়।

প্রিয় পাঠক অনলাইন নিউজ পোর্টাল দ্যামেইলবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন themailbdjobs@gmail.com ঠিকানায়।

More articles

সর্বশেষ

x  Powerful Protection for WordPress, from Shield Security
This Site Is Protected By
Shield Security
Seraphinite AcceleratorOptimized by Seraphinite Accelerator
Turns on site high speed to be attractive for people and search engines.