...
বৃহস্পতিবার, মে ১৬, ২০২৪

দ্বিন পালনে দৃঢ়তার অর্থ বিপদ ডেকে আনা নয়

যা যা মিস করেছেন

মুমিনের জন্য ইসলাম পালন ও প্রতিপালনে দৃঢ়তা প্রশংসনীয়। কোরআন ও হাদিসে দ্বিনের ওপর দৃঢ়তা বা ইস্তিকামাত অর্জনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, দ্বিনের ওপর অবিচল মানুষের প্রশংসা করা হয়েছে। তবে ইসলাম একই সঙ্গে তা যেন বাড়াবাড়ি ও বোঝায় পরিণত না হয় সে ব্যাপারেও সতর্ক করে দিয়েছে; বরং ইসলাম মুসলিম উম্মাহকে মধ্যপন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে মুসলিম উম্মাহকে মধ্যপন্থী জাতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘এভাবে আমি তোমাদের এক মধ্যপন্থী জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি—যাতে তোমরা মানবজাতির জন্য সাক্ষীস্বরূপ এবং রাসুল তোমাদের জন্য সাক্ষীস্বরূপ  হন।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৪৩)

আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এই আয়াতে ব্যবহৃত ‘মধ্যপন্থী’ শব্দের অর্থ ‘আদল’ দ্বারা করেছেন। যার অর্থ ন্যায়পরায়ণ ও ভারসাম্যপূর্ণ জাতি। (তাফসিরে ইবনে কাসির) আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘মধ্যপন্থা হলো বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির মধ্যবর্তী ন্যায়ানুগ অবস্থান—যাতে পার্থিব ও অপার্থিব কল্যাণ নিহিত।’ (আল-ফাওয়াইদ, পৃষ্ঠা : ১৩৯)

 

দ্বিন পালনে দৃঢ় থাকার অর্থ

ইস্তিকামাত বা দ্বিনের ওপর দৃঢ় থাকার ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে হাজার আস্কালানি (রহ.) বলেন, ‘দ্বিন পালনে দৃঢ়তা বা ইস্তিকামাত হলো ভালো কাজ করা এবং পাপ ও মন্দ কাজ পরিহারের ক্ষেত্রে আল্লাহর আদেশ মেনে চলা।’ (ফাতহুল বারি : ১৩/২৫৭)

শায়খ জাইনুদ্দিন আবদুর রহমান ইবনে আহমদ (রহ.) বলেন, ‘দ্বিন পালনে দৃঢ়তা হলো সরল-সঠিক পথ ও সুদৃঢ় দ্বিনের ওপর চলা ডানে ও বাঁয়ে ভ্রুক্ষেপ করা ছাড়া। প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সব ধরনের ভালো কাজের অনুসরণ ও মন্দ কাজ পরিহার করা এর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং ইস্তিকামাত হলো দ্বিনের সামগ্রিক বৈশিষ্ট্য ধারণ করা এবং বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি পরিহার করা। কেননা তা (বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি) ইসলামী শরিয়তে নিষিদ্ধ।’ (জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম : ২/৬০৭)

 

দ্বিনের ওপর দৃঢ় থাকার নির্দেশ

ইসলাম দ্বিন পালনে ও প্রতিপালনে মুমিনদের দৃঢ় থাকার নির্দেশ দিয়েছে। কোরআন ও হাদিসে এ ব্যাপারে ‘আদেশসূচক’ বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে—যা কোনো কিছু ওয়াজিব বা আবশ্যক হওয়া বোঝায়। আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং আপনি যেভাবে আদিষ্ট হয়েছেন তাতে স্থির থাকুন এবং আপনার সঙ্গে যারা ঈমান এনেছে তারাও স্থির থাকুক। সীমা লঙ্ঘন কোরো না। তোমরা যা করো আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ১১২)

সুফিয়ান ইবনে আবদুল্লাহ সাকাফি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন—‘আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে এমন একটি কথা বলুন, যা আমি ধারণ করতে পারি। তিনি বললেন, তুমি বলো, আল্লাহই আমার প্রতিপালক। অতঃপর এতে সুদৃঢ় থাক।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৪১০)

 

সাফল্য লাভের জন্য দৃঢ়তা থাকা আবশ্যক

মানুষের পার্থিব ও পরকালীন জীবনে সাফল্য লাভের জন্য দ্বিন পালনে দৃঢ় থাকা আবশ্যক। দ্বিনের ওপর যারা দৃঢ়পদ থাকবে আল্লাহ তাদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘যারা বলে, আল্লাহ আমাদের প্রতিপালক। অতঃপর অবিচল থাকে, তাদের কাছে অবতীর্ণ হয় ফেরেশতা এবং বলে, তোমরা ভীত হয়ো না, চিন্তিত হয়ো না। তোমাদের যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল তার জন্য আনন্দিত হও।’ (সুরা : হা-মিম-সাজদা, আয়াত : ৩০)

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন! আমি তোমাদের মতোই মানুষ, আমার কাছে ওহি অবতীর্ণ হয় যে, তোমাদের ইলাহ এক ও অদ্বিতীয়। অতএব তোমরা তাঁর পথ দৃঢ়ভাবে অবলম্বন করো এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। দুর্ভোগ মুশরিকদের জন্য।’ (সুরা : হা-মিম-সাজদা, আয়াত : ৬)

 

দৃঢ়তার অর্থ বিপদ ডেকে আনা নয়

দ্বিন পালনে দৃঢ়তা যেমন কাম্য তেমনি অতি কঠোর হওয়া বা বাড়াবাড়ি পরিহারযোগ্য। বিশেষত যখন তা নিজের ও অন্যের জন্য বোঝা হয়ে যায় এবং তাতে নিজের ও অন্যের ক্ষতির ঝুঁকি তৈরি হয়। সাইয়েদ কুতুব শহীদ (রহ.) বলেন, ‘ইস্তিকামাত বা দৃঢ়তা হলো যথানিয়মে ভারসাম্যপূর্ণভাবে দ্বিন পালন করা—কোনো ধরনের বিকৃতি ছাড়া। দৃঢ়তার ব্যাপারে আদেশসূচক বাক্যের বিপরীতে নিষেধাজ্ঞাপক যেসব বাক্য ব্যবহৃত হয়েছে তা থেকে বোঝা যায়—ত্রুটি, অপূর্ণতা ও সংক্ষেপণকে নিষিদ্ধ করা হয়নি; বরং অবাধ্যতা ও সীমা লঙ্ঘন থেকে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ তাঁর দ্বিন যেভাবে অবতীর্ণ করেছেন সেভাবে দেখতে চান। কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি ও সীমা লঙ্ঘন ছাড়াই তিনি তাঁর ওপর দৃঢ় থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা বাড়াবাড়ি ও সীমা লঙ্ঘন ইসলামকে তার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য থেকে বের করে দেয়।’ (বিস্তারিত দেখুন : আল-মুতাতাররিফুন, পৃষ্ঠা : ২২)

বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয় মহানবী (সা.)-এর একটি হাদিস থেকে। তিনি বলেন, ‘তোমরা দ্বিনের প্রতি নিষ্ঠাবান হও এবং নৈকট্য অর্জন করো। জেনে রেখো! তোমাদের কাউকে তার আমল জান্নাতে প্রবেশ করাবে না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৪৬৪)

সাওবান (রা.)-কে উদ্ধৃত করে আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রহ.) এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘বান্দার কাছে প্রত্যাশা হলো দৃঢ়তা বা পূর্ণ নিষ্ঠা। তবে যারা তা অর্জন করতে পারবে না, পূর্ণ নিষ্ঠার কাছাকাছি অবস্থানে যাওয়ার চেষ্টা করবে। যেমন কেউ একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করে তীর নিক্ষেপ করে, অতঃপর তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও তীরটি তার কাছাকাছি থাকে।’ (মাদারিজুস-সালিকিন : ২/৭৯)

‘আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া শুধু আমল দিয়ে জান্নাতে যাওয়া যাবে না’—বলে রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রকৃতপক্ষে আমলের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করতে নিরুৎসাহ করেছেন।

 

দ্বিন পালনে অতি কঠোর হওয়া নিন্দনীয়

ইসলাম মানবপ্রকৃতির অনুকূল একটি সহজ ও মধ্যপন্থী ধর্ম। যাতে অতি কঠোরতা ও শিথিলতা উভয়টি নিষিদ্ধ। ইমাম তহাবি (রহ.) বলেন, ‘আসমান ও জমিনে আল্লাহর একমাত্র দ্বিন ইসলাম এবং তা কঠোরতা ও শিথিলতার মধ্যবর্তী। (শরহুত-তহাবি লি-ইবনিল ইজ, পৃষ্ঠা : ৫৮৫)

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি দ্বিনের ব্যাপারে তোমাদের ওপর কোনো কঠোরতা আরোপ করেননি।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৭৮)

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান, তোমাদের জন্য যা কষ্টকর তা চান না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৫)

রাসুলুল্লাহ (সা.)-ও দ্বিনের ব্যাপারে অতি কঠোর হতে নিরুৎসাহিত করেছেন, নিষেধও করেছেন। বুরাইদা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) তিনবার বলেন, তোমরা সহজ ও ভারসাম্যপূর্ণ পথ অবলম্বন করো। কেননা যে এই দ্বিনের ব্যাপারে কঠোর হবে, দ্বিন তাকে পরাজিত করবে।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২২৯৬৩)

অন্য হাদিসে এসেছে, ‘সাবধান দ্বিনের ব্যাপারে তোমরা বাড়াবাড়ি কোরো না। কেননা তোমাদের আগে যারা ছিল ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি তাদের ধ্বংস করেছে।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৩০৫৭)

বরং মানুষের প্রয়োজনে দ্বিনের ব্যাপারে সহজ হওয়ার শিক্ষা দিয়েছে ইসলাম। আবু মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, অমুক ব্যক্তি নামাজ দীর্ঘ করে। যে কারণে আমি ফজরের নামাজ থেকে পেছনে থাকি। বর্ণনাকারী বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে কোনো ওয়াজের মধ্যে সেদিনের চেয়ে বেশি রাগান্বিত হতে দেখিনি। এরপর তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ ঘৃণা সৃষ্টিকারী আছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে লোকদের নিয়ে নামাজ আদায় করে, সে যেন সংক্ষেপ করে। কারণ তাদের মধ্যে রোগী, বৃদ্ধ এবং কাজের লোক থাকে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬১১০)

অনুমতি ব্যতিত এই সাইটের কোনো কিছু কপি করা কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয়।

প্রিয় পাঠক অনলাইন নিউজ পোর্টাল দ্যামেইলবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন themailbdjobs@gmail.com ঠিকানায়।

More articles

সর্বশেষ

x  Powerful Protection for WordPress, from Shield Security
This Site Is Protected By
Shield Security
Seraphinite AcceleratorOptimized by Seraphinite Accelerator
Turns on site high speed to be attractive for people and search engines.