দেশে দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিতভাবে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর একটা ভালো প্রভাব সমাজে পড়ার কথা। বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের নেতা-কর্মী বা সমর্থকদের প্রতি অধিকতর সহনশীলতা ও শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ ঘটার কথা। কিন্তু সমাজে তার বিরাট ঘাটতি চলছে। নির্বাচনে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ধারণাটি মুখ্যত দীর্ঘকাল দুই প্রধান দলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এখন আর সেটা আগের মতো প্রাসঙ্গিক নয়। এখন ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক চর্চা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কোনো নির্বাচন হলেই সেখানে অভ্যন্তরীণ প্রতিপক্ষের সংখ্যাধিক্য ঘটছে। বিদ্রোহী প্রার্থীও যেমন একাধিক, তেমনি তাদের ঘিরে বিভিন্ন উপদলীয় দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিচ্ছে।
চলমান উপজেলা নির্বাচনে হানাহানির ব্যাপক বিস্তার তারই প্রতিফলন। কিন্তু নতুন যে বিষয়টি আমাদের উদ্বেগের কারণ সেটি হলো, নির্বাচনী সহিংসতার অংশ হিসেবে গণধর্ষণকে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার শুরুর প্রবণতা দেখা দিচ্ছে কি না। বাস্তবে সত্যিই তা ঘটেছে, তা হলফ করে বলার সময় আসেনি, কারণ সেটা তদন্ত এবং বিচারসাপেক্ষ। কিন্তু নোয়াখালীতে এ রকম কয়েকটি ঘটনার অভিযোগ অল্প সময়ের ব্যবধানে দেখা দেওয়ার পর আমরা নিরুদ্বিগ্ন থাকতে পারি না। রাজনৈতিক দল এবং জনপ্রশাসনকে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই, সমাজে অসহনশীলতা ও বিচারহীনতার একটা দুর্ভাগ্যজনক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এবং তা থেকে দ্রুত বেরোনোর পথ সহজ নয়। সমাজে নারীর মর্যাদা এবং অবস্থান এখনো ততটা সুদৃঢ় হয়নি।
নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ভোট-সংশ্লিষ্ট গণধর্ষণের দুটি ঘটনাই কেবল ঘটেনি, ওই একই জেলার কবিরহাট উপজেলায় স্থানীয় এক বিএনপি নেতাকে কারাগারে পাঠিয়ে তাঁর স্ত্রীকে গণধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গত ২৮ জানুয়ারির এ ঘটনায় স্থানীয় যুবলীগ নেতা এজাহারভুক্ত আসামি এবং তিনি পলাতক রয়েছেন। ভুক্তভোগীর স্বামীর দাবি, বিষয়টি নির্বাচনী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তবে গত ৩০ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের পর গত ৩১ মার্চে সুবর্ণচরেই একই ধরনের অভিযোগ ওঠা বেশ দুশ্চিন্তার বিষয়। এটা এমন একটা সম্ভাব্য ব্যাধি, যা অঙ্কুরেই বিনাশ করতে যা যা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তাই নিতে হবে।
আমরা বিষয়টি নিয়ে নোয়াখালীর পুলিশ প্রশাসনের একজন মুখপাত্রের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁর দাবি, ৩০ ডিসেম্বর ধানের শীষের প্রার্থীকে ভোটদানের ঘটনায় গণধর্ষণের যে খবর সংবাদমাধ্যমে উঠেছে, তেমন অভিযোগ বাদী এজাহারে বা পরে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সরাসরি উল্লেখ করেননি। বরং ‘পূর্বশত্রুতার’ কথা উল্লেখ করেছেন। আমরা তাঁর এই দাবি নাকচ না করে বলব যে অভিযোগ যা উঠেছে, সে বিষয়ে পুলিশের দায়িত্বশীল তদন্ত এবং দ্রুত ন্যায়বিচার করাই হলো এর সদুত্তর। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারলেই সন্দেহ-সংশয় ঘুচবে।
আমরা অবশ্যই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বক্তব্যের ভিত্তিতেই কোনো মন্তব্যকে সমীচীন মনে করছি না। কিন্তু সার্বিকভাবে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং তার প্রতি এলাকাবাসীর প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় নিলে এই রকম সন্দেহ-সংশয়কে দ্রুত নাকচ করা কঠিন। গত ৩০ ডিসেম্বরের ধর্ষণের ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ অভিযুক্তকে তাৎক্ষণিক দল থেকে বহিষ্কার করেছিল। তারা সরকারি তদন্তের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করেনি। সুবর্ণচরে গত রোববারের ঘটনায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ভাইস চেয়ারম্যান পদে ‘তালা’য় না দিয়ে ‘চশমা’ প্রতীকে ভোট দেওয়ায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ। অথচ উভয় প্রার্থীই ক্ষমতাসীন দল-সমর্থিত।
আমরা আশা করব, প্রশাসন সমস্যা অস্বীকার করার প্রথাগত মনোভাব পরিহার করে চলবে এবং অভিযোগের সংবেদনশীলতা বিবেচনায় অধিকতর দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে।