...
বৃহস্পতিবার, মে ১৬, ২০২৪

হলি আর্টিজান মামলা থেকেও অব্যাহতি পেলেন তাহমিদ

যা যা মিস করেছেন

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ২০১৬ সালের জুলাইয়ে জঙ্গি হামলার সময় কয়েকজনের মতো তাহমিদ হাসিব খান জিম্মি অবস্থায় ছিলেন রাতভর। পরদিন সকালে অপারেশন থান্ডারবোল্টের আগ-মুহূর্তে অন্যদের সঙ্গে উদ্ধার করা হয় তাকেও।

Thamid the mail bd

তবে ইন্টারনেটে কয়েকটি ভিডিও এবং স্থিরচিত্র ছড়িয়ে পড়ার পর এ হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আটক করা হয় তাহমিদকে। কানাডার টরন্টো ইউনিভার্সিটির এই শিক্ষার্থী ৫৪ ধারায় গ্রেফতার হন গত বছরের ৩ আগস্ট।

একাধিবার রিমাণ্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ৩ অক্টোবর ৫৪ ধারার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় তাহমিদকে। ওইদিনই আদালতের নির্দেশে তার বিরুদ্ধে একটি নন-প্রসিকিউশন দায়ের করা হয়।

রবিবার (১৬ এপ্রিল) সেই মামলা থেকেও অব্যাহতি পেলেন তিনি। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, তাহমিদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি।

গত বছরের অক্টোবরে গ্রেফতার হওয়ার পর তাহমিদের কাছে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে হলি আর্টিজানের জঙ্গি হামলার বিস্তারিত তথ্য জানতে চায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তিনি নিজের হাতে লিখে সেই রাতের ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।

তাহমিদ তার বর্ণনায় বলেন, ‘রাত ৮টা থেকে ৮টা ১০ মিনিটের মধ্যে আমি পৌঁছাই হলি আর্টিজানের সামনে। ফাইরুজকে ফোন দিলে সে আমাকে রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করার জন্য জানায়। আমি তার কথামতো ঢুকি। প্রথমে গিয়ে বসেছিলাম বারান্দার একটি টেবিলে। এর ১০ মিনিট বা তার কম সময়ে ফাইরুজ ও আমাদের বন্ধু তাহানা চলে আসে। আমরা সিদ্ধান্ত নিই আইসক্রিম খাবো। যেহেতু রেস্টুরেন্টে খাচ্ছি না, তাই বারান্দায় বসা যাবে না বলে জানায় ওয়েটার। তাই আমাদের বসতে হয় লেকের পাশঘেষে একটি গোল ছাউনির নিচে।’

জঙ্গি হামলা শুরুর ঘটনা জানিয়ে তাহমিদ বলেন, “৮টা ৪০ মিনিটে প্রথম আওয়াজ শুনি। বাইরে বিকট আওয়াজ হয়। তখনও আমরা ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দেইনি। তারপর হলো দ্বিতীয়, তারপর তৃতীয় এবং তারপর অনবরত হতে থাকে। আমরা সতর্ক হয়ে যাই। শুনি যে আল্লাহ আকবর ও বিভিন্ন ধার্মিক কথা উচ্চস্বরে বলতে বলতে ঢুকে পড়ে জঙ্গিরা। প্রথমে দেখি দুইজন, হাতে বন্দুক। তাদের দিকে না তাকিয়ে আমাদের টেবিল ফেলে তার পেছনে লুকিয়ে থাকি।

কিছুক্ষণ পর একটি ছেলে ১০ ফুট দূর থেকে জোরে জোরে জানতে চাইলো, ‘তোমরা কি মুসলিম?’ আমরা তিনজনই বলি— ‘জি ভাইয়া, আমরা মুসলমান।’ তারপর ছেলেটা বললো— তারা মুসলিমদের নয়, বরং কাফেরদের মারতে এসেছে। এরপর সে বারান্দার দিকে যায়। আমরা আবার লুকিয়ে থাকি।”

তাহমিদ বলেন, “আওয়াজ কমতে শুরু করলে দেখি ছেলেটা (নিবরাস) আবার এগিয়ে এলো আমাদের দিকে। এসে তার পিছু পিছু যেতে বললো। তখন সম্ভবত রাত ৯টা ৫ থেকে ৯টা ১০ মিনিট হবে। ভেতরের দৃশ্য না দেখার চেষ্টা করলাম। চারদিকে রক্ত ও মরদেহ পড়ে আছে। দেখলাম একটি টেবিলে একটি পরিবার মাথা নিচু করে বসে আছে। আশেপাশে নিবরাসের মতো আরও কিছু ছেলেকে দেখলাম অস্ত্র হাতে। তারা আমাদের টেবিলে বসতে বললো। কিছুক্ষণ পরপর জঙ্গিরা বলছিল, ‘মাথা তুলবি তো গুলি করে দিবো।’ একসময় আমাদের বলে, ‘তোমাদের আত্মীয়দের জানিয়ে দাও তোমরা ভেতরে আছো।’ তখন যে যার বাসায় ফোন দিয়ে জানায়। ফাইরুজের ফোনে সম্ভবত আমার দুলাভাই ফোন দেয়, তাকে আমি জানাই ভেতরে আছি।”

রাতের খাবার দেওয়া প্রসঙ্গে তাহমিদ বলেন, ‘একসময় (জঙ্গিরা) বেয়ারাদের ডেকে খাবার নিয়ে আসার হুকুম দেয়। বেয়ারারা বেকারি থেকে কেক নিয়ে এলে আমাদের এবং তাদের সামনে পরিবেশন করে দিতে বলে। পানিও দেওয়া হয়। আমাদের বাথরুমে যাওয়ার সুযোগও দেয় ওরা। আমার মনে আছে, নিবরাস আবার আমাদের সামনে এসে বসে। তখন সে বলে, তারা নাকি আইএস। এই ঘৃণার কাজ নাকি ভালোর জন্যই করে তারা। বাংলাদেশে বিদেশিরা নিজেদের মতো ঘোরাফেরা করে। দেশে নাকি শিরকি আইন চলে। এছাড়া আরও কিছু কথা বলে, সেসব বুঝিনি। আমাদের কোনও প্রশ্ন থাকলে তাকে করতে বলে। আমরা কথা ঘুরিয়ে বলার চেষ্টা করি আমাদের ছেড়ে দিতে। একসময় সে বলে, আমাদের মৃত্যু তাদের হাতে হবে না, বরং পুলিশের হাতে নাকি হবে। তখনও আশা ছিল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হয়তো আমাদের উদ্ধারের চেষ্টা করবে।’

তাহমিদ তার বর্ণনায় আরও বলেন, “একসময় তারা একটি কক্ষের দরজা খুলতে সক্ষম হয়। খোলার পর আমরাও দেখতে পাই সেখানে একটি ফ্রিজ। ভেতরে ছিলেন দু’জন। একজন বাংলাদেশি, আরেকজন বিদেশি। পোশাক দেখে মনে হলো তারা বাবুর্চি। প্রথমে বাঙালিকে জিজ্ঞেস করা হলো, সে কি মুসলিম? সে মুসলমান বলায় তাকে সরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর অন্যজনকে তারা জিজ্ঞেস করে, ‘হোয়ার আর ইউ ফ্রম?’ তিনি উত্তরে জানান, ‘আই অ্যাম জাপানিজ।’ শুনেই তারা নির্মমভাবে গুলি করে তাকে। এ দৃশ্য দেখার মতো ছিল না। রাত ১২টা থেকে ১টার মধ্যে তারা ভেতরের লাইট অফ করে দেয়। আমাদের ভয় বেড়ে যায়। তখনও আমাদের সামনে দিয়ে টহল দিয়ে মাথা নিচু রাখার আদেশ দেয়। একসময় বেয়ারাদের ডাকে। তারা বিভিন্ন মানুষকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করছিল। আমরা সবাই দোয়া পড়তে থাকি। বেয়ারাদের দুইজনকে সিঁড়ির পেছনে একটি রুমে যেতে বলে। কিছুক্ষণ পর টেনে টেনে দুটি বড় সিলিন্ডার আনে তারা। একটি রাখে সামনের দরজার পাশে, অন্যটি রাখা হয় লেকের ধার দিয়ে কাঁচের পাশে। আমাদের জানায়, এটা নাকি আমাদের সবার সুরক্ষার জন্য। এগুলো দেখলে নাকি পুলিশ গুলি করবে না।”

তাহমিদের ভাষ্য, ‘রাত সাড়ে ১২টার পর যা ঘটেছিল তা এখনও আমার কাছে লোমহর্ষক। যতদূর সম্ভব কোনও নির্দেশে তারা প্রতিটি লাশ কুপিয়েছে। দেখতে না চাইলেও আওয়াজ শুনতে হয়েছে আমাদের। এর মধ্যে এক-দুইজন তখনও মারা যাননি। তারা সেই দুইজনকে নির্মমভাবে কুপিয়ে ও জবাই করে মেরেছে। অনেকক্ষণ পর কোপানোর শব্দ থামে। তারা একসময় ফ্ল্যাশ দিয়ে সেই লাশগুলোর ছবি তুলে।’

তাহমিদ বলেন, “জঙ্গিরা হাসনাত সাহেবকে ডাক দেয়। তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘তুমি আসো।’ আমি প্রথমে না তাকিয়ে পরে তাকাই। ফ্যাকাসে গলায় জানতে চাই, ‘ভাইয়া আমি?’ বলে, ‘হ্যাঁ।’ তার পিছু নিতে বলায় তাই করি। বন্দুকের মাথায় যা বলবে তাই তো করবো। তারপর সে বলে, ‘ওপরে আসো।’ তখন চোখের আড়াল হয় ফাইরুজ। তাদের চোখে ভয়। আমি জানি না কি হবে। চারদিক নিস্তব্ধ। দোতলায় ওঠার পর ছেলেটা তার এক সহযোগীকে আমাদের বন্দুক দিতে বলে। খালি করে দিতে বলেছিল নাকি সে নিজেই বারুদশুন্য করেছে তা মনে নেই। কিন্তু এটা মনে আছে, সে ট্রিগারে চাপ দেওয়ার পর ‘ক্লিক’ শব্দ হয়। এর মাধ্যমে আমাকে বোঝায় যে, বন্দুকে গুলি নেই। এটা আমার মনে আছে কারণ, আমি জানতাম কিছু করতে পারবো না। তারপর আমাকে হাতে বন্দুক দেওয়ার চেষ্টা করে। একটি কালো পিস্তল। আমি প্রথমেই না করে বলি, ‘ভাইয়া আমি পারবো না।’ সে হাসনাত সাহেবকে দরজা খুলতে বলে এবং আমাকে আবার পিস্তল নিতে বলে। ভয়ে আমি শেষ পর্যন্ত হাতে নিই। প্রথমে হাসনাত সাহেব ছিলেন, তার পেছনে আমি। কিছুক্ষণ পর ওই ছেলে আমাদের পিছু আসে। তার হাতে বড় বন্দুক।”

হাসনাত করিম ও তাহমিদকে ব্যবহার করে হলি আর্টিজান বেকারির আশেপাশের পরিস্থিতি দেখেছিল জঙ্গিরা। সেই বর্ণনা জানিয়ে তাহমিদ বলেন, “প্রথমে আমাদের চিলেকোঠার পেছনে দেখার নির্দেশনা দেয়। তারপর দেখতে বলে পাশের দোতলার বাড়ি। এরপর লেকের দিকে কার্নিশ চেক করায় আমাদের দিয়ে। তারপর লেকের দিকে তাকিয়ে ‘দ্যাখ, ওইদিকে বসে আছে পুলিশ’ বলে টিটকানি হাসি দেয়। আমার ভয়ে হাত কাঁপতে থাকে। তারপর তাহানার বাসার ছাদ দেখায়। সেখানে তাকিয়ে দেখি একটি মাথা। ছেলেটা বলে, ‘দ্যাখ স্নাইপার আছে।’ তারপর হাসি দেয় ঠাট্টার ভঙ্গিতে। ১০ মিনিট পর তার নির্দেশে আবার আমরা ফিরে চলে আসি। দোতলায় আবার বন্দুক নিয়ে নেয়।”

ছেড়ে দেওয়ার জন্য জঙ্গি রোহানের কাছে অনুরোধ জানিয়েছিলেন হাসনাত ও তাহমিদ। এ তথ্য দিয়ে তাহমিদ বর্ণনায় লিখেছেন, “ছাদ থেকে নেমে আরেকবারের মতো ফাইরুজের চেহারা দেখতে পাই। সে আমাকে দেখে কেঁদে দেয়। ফিরে আবার হেডডাউন করে রাখি। যেহেতু আমাদের মারেনি তাই আমাদের ছেড়ে দিতে দেওয়ার জন্য ছেলেটাকে ছাদে বলি আমরা। তখন হাসনাত সাহেব বলেন, ‘আমাদের না ছাড়লেও বাচ্চাদের আর মহিলাদের ছেড়ে দিন।’ আমি একপর্যায়ে জিজ্ঞেস করি, নিচের অন্যদের কাছে জানতে চাইবো আমাদের ছাড়বেন নাকি। তখন সে একটু রাগ হয়েই বলেছিল, সে শুধু আমাদের মতামত নিচ্ছিল।”

তাহমিদ আরও বলেছেন, “(ছাদ থেকে ফিরে) শেষবারের মতো বাঁচার শেষ আশা ছেড়ে দেই। ফাইরুজের দিকে আর তাকাই না বেশি। মাথা নিচু করে থাকি। আস্তে আস্তে শুনি তাদের প্রস্তুত হওয়ার আওয়াজ। চেইন ও বিভিন্ন ‘ক্লিক’ শব্দ। একটু পর রোহান আবার নামে। আমাদের দাঁড়াতে বলে। হাসনাত সাহেবকে দিয়ে দরজা খোলায়। আমি রাতে বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে পারিনি দেখে কথা বলি একবার। নিবরাস সবার ফোনগুলো নিয়ে এসে বললো যার যেটা ভালো লাগে নিয়ে নিতে। তখন আমরা পাঁচজনকে দেখি। সশস্ত্র ছিল তারা। যাওয়ার আগে বেশি কথা বলেনি। আমাদের ভালো হয়ে থাকতে ও কোরআনের বঙ্গানুবাদ পড়তে বলে। ডা. প্রকাশকে একটি ছোট কোরআন দেয়। তারপর আমরা বাগানের ছোট গেট দিয়ে বের হই। রাস্তার মাথায় পুলিশ দেখি, ফলে সেদিকে হেঁটে এগোতে থাকি।”

গত রবিবার গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার ঘটনায় তথ্য গোপনের অভিযোগে রাজধানীর ভাটারা থানায় দায়ের করা নন প্রসিকিউশন মামলায় খালাস পান কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাহমিদ হাসিব খান। ঢাকা মহানগর হাকিম মো. মাহমুদুল হাসান তাকে খালাস দেন।

মামলার নথি থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালের জুলাইয়ে হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে ৫৪ ধারায় তাহমিদকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাকে ৫৪ ধারা থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়। এর পরই তার বিরুদ্ধে পুলিশকে অসহযোগিতা করার অভিযোগ আনা হয়।

উল্লেখ্য, গত বছরের ৪ আগস্ট রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার জি-ব্লকের একটি বাসা থেকে তাহমিদকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নেওয়া হয়। পরবর্তীতে ‘সংশ্লিষ্টতা না পাওয়ায়’ ২৮ সেপ্টেম্বর তাহমিদ হাসিব খানকে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির ৫৪ ধারার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন এবং সরকারি কর্মচারীর নোটিশের জবাব না দেওয়ায় একটি নন-প্রসিকিউশন মামলা দায়ের করেন।

অনুমতি ব্যতিত এই সাইটের কোনো কিছু কপি করা কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয়।

প্রিয় পাঠক অনলাইন নিউজ পোর্টাল দ্যামেইলবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন themailbdjobs@gmail.com ঠিকানায়।

More articles

সর্বশেষ

x  Powerful Protection for WordPress, from Shield Security
This Site Is Protected By
Shield Security
Seraphinite AcceleratorOptimized by Seraphinite Accelerator
Turns on site high speed to be attractive for people and search engines.