মঙ্গলবার, এপ্রিল ১৬, ২০২৪

গতকাল পর্যন্ত কোটিপতি ছিলাম, এখন পথের ফকির

যা যা মিস করেছেন

dcc-market-the-mail-bd

বিধ্বস্ত চেহারা। চোখে-মুখে হতাশার ছাপ। দু’এক পা আগে-পিছে পায়চারি করছেন। কিন্তু মুখে কোনো কথা নেই। চোখের সামনেই ধোঁয়ারকুণ্ডলি। ছলছল চোখে মাঝে মাঝে সেদিকে তাকাচ্ছেন কামাল হোসেন। দেখেছেন তিলে তিলে গড়ে তোলা ব্যবসার পরিণতি।

সোমবার মধ্যরাতে গুলশানের উত্তর সিটি করপোরেশন কাঁচাবাজারে আগুন লাগার খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন তিনি। কিন্তু ততক্ষণে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছে তার সাজানো বাগান। চারতলা ভবনের দোতলায় তার দোকানটির কোনো চিহ্ন নেই। দোকানের মালিক কিনা জিজ্ঞেস করতেই কামাল হোসেন বলেন, কাল পর্যন্ত মালিকই ছিলাম, এখন নেই। দোকান না থাকলে মালিক থাকি কি করে?

ধ্বংসস্তূপের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলেন, ওখানেই ছিল তার দোকানটা। দোকানটির নাম আনিকা বেবি ফুড। দোতলার ৬নং দোকান। কিন্তু এখন সবশেষ। তিনি বলেন, দোকানে ৩৫-৪০ হাজার ক্যাশ টাকা ছিল সেগুলোও বের করতে পারিনি। তিনি বলেন, প্রতিদিন দোকান বন্ধ করে যেতে দেরি হয়। তাই দোকানে রেখে যাই। পরদিন সকালে এসে সেগুলো ব্যাংকে জমা দিই। এ ছাড়া সবমিলিয়ে প্রায় ৩০ লাখ টাকার পণ্য ছিল দোকানে। সেগুলো এখন আগুনের পেটে।

কামাল বলতে থাকেন, বিদেশে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে কিছু পুঁজি জমিয়েছিলাম। গত দু’বছর আগে দেশে ফিরে এখানে ব্যবসা শুরু করেন। ভালোই চলছিল। কিন্তু মুহূর্তেই তা শেষ হয়ে গেলো। কামালের মতো শত শত ব্যবসায়ী গতকাল দিনভর নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে দেখেছেন তাদের জীবনে অন্ধকার নেমে আসার দৃশ্য। কেউ মাথায় হাত দিয়ে, কেউ মুখ নিচু করে বসে আছেন। কেউ বা তার দুঃখের কথা, ব্যবসা গড়ে তোলার সংগ্রামের কথা বলছেন পাশের জনকে।

ভবিষ্যতের অনিশ্চিত জীবনের কথাও বলছেন কেউ কেউ। আবার কেউ আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন যদি সামান্য কিছু মালামাল উদ্ধার করা যায়। সকাল-দুপুর-গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলেও তারা অনেকেই নাওয়া-খাওয়া করেননি। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের অভিযোগ- তাদেরকে উচ্ছেদ করতে পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগানো হয়েছে। আগুন নেভাতে নিয়োজিত ফায়ার সার্ভিসের তৎপরতা নিয়েও তারা প্রশ্ন তোলেন। ব্যবসায়ীরা তাদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করেন। তাদের দাবি এই ঘটনায় প্রায় হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সোমবার রাত দুইটার দিকে ডিএনসিসি’র এই মার্কেটের কাঁচাবাজারেরপেছন দিক থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পরেই ৪ তলা মার্কেটের কাঁচাবাজারের অংশটি ধসে পড়ে। মার্কেটের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন আবদুর রাজ্জাক নামে এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, দোতলায় তার শ্যালক আলম সরকারে আহনাদ ভ্যারাইটি স্টোর। এখানে নানা বিদেশি প্রডাক্ট ছিল। ক্যাশে নগদ টাকা ছিল। দোকানের যাবতীয় হিসাবে খাতা, পাসপোর্টসহ প্রায় ৫০-৬০ লাখ টাকার মালামাল ছিল। প্রথমদিকে এসে তাড়াহুড়ো করে দেড় হাজার টাকার মতো মালামাল উদ্ধার করেছি। বাকিটা ধ্বংসস্তূপের নিচে।

তিনি বলেন, আলমের একমাত্র আয়ের উৎস এই দোকনটি। পরিবারটি এখন পথে বসবে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কাঁচাবাজার মার্কেটের নিচ তলায় অনেকগুলা চিকেন হাউস, ১০-১২টি ভেজিটেবল শপ, ৩০টি জেনারেল স্টোর, ৪০টি ক্রোকারিজের দোকান, ১০-১২টা ওয়ানটাইম, ১০টি ফিস প্রোডাক্টের দোকান। সবমিলে নিচতলায় কাঁচা তরিতরকারি, ফলমূলসহ প্রায় সাড়ে ৪শ’ দোকান ছিল। মার্কেটের দোতলায় ছিল ১৮০টি দোকান। দোতলার দোকানগুলোর বেশির ভাগেই প্রসাধনী, খাদ্যপণ্য, নানা বিদেশি পণ্যের দোকান।

ব্যবসায়ী মিজান জানান, মিজান চিকেন হাউসের নামে তার একটি দোকান রয়েছে। দোকানে ফ্রোজেন করা মালামাল, দামি তিনটি বড় সাইজের ফ্রিজসহ প্রায় ৫ লাখ টাকার মালামাল ছিল। তার এখান থেকে তিনি দেশের বিভিন্নস্থানে মালামাল সরবরাহ করেন। বিভিন্ন পার্টিতেও খাবার সরবরাহ করেন। সেই সংক্রান্ত সকল হিসেবে খাতা, চেকবই, ক্যাশ টাকাও দোকানে ছিল। সোমবার সাড়ে ৮টার দিকে তিনি দোকান বন্ধ করে বাসায় ফেরেন। আড়াইটার সময় খবর পান মার্কেটে আগুন লেগেছে। তিনটার দিকেই ঘটনাস্থলে পৌঁছেন। এসে দেখেন ভবনটি ধসে গেছে। চোখের সামনে জ্বলে যাচ্ছে আমার দোকান।

তিনি বলেন, এসে দেখি ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট। একটি ভেতরে এবং ২টি বাইরে। ভেতরের ইউনিটটি কাজ শুরু করার এক মিনিটের মধ্যেই পানি শেষ হয়ে যায়। তিনি বলেন, আমার ১২ সদস্যের সংসার চলে এর ওপর। ছোট তিন ভাই লেখাপড়া করছে। ১০ বছর ধরে তিনি তিলে তিলে ব্যবসাটি বড় করেছেন। এক নিমিষেই তা শেষ হয়ে গেলো। এখন কীভাবে সংসার চলবে। কীভাবে তাদের লেখাপড়া করাবো। আমি এখন পথের ভিখারি।

মিজান আরো বলেন, আমার দোকানে ৫ জন কর্মচারী কাজ করতো। তাদেরও সংসার চলতো এর ওপর দিয়েই। এখন তাদেরই বা কীভাবে চলবে? তিনি জানান, আগুনে জিয়া জেনারেল স্টোরের নগদ ২০ লাখ টাকা পুড়ে গেছে। বিসমিল্লাহ চিকেন হাউসের কর্মচারী রকিব জানান, তিনি সহায়-সম্বলহীন। এখানে কাজ করেন প্রায় দু’বছর হলো। তার মালিকের অধীনে ৫ জন কর্মচারী রয়েছে। তারা দোকানেই ঘুমান-রান্না-খাওয়া চলে। রকিব জানান, তিনি ৮ হাজার টাকা বেতন পান। কেউ কেউ বেশিও পান। এই দিয়েই তাদের সংসার চলে। এখন কোথায় কাজ পাবো জানি না।

তিনি বলেন, সোমবার রাত ১০টার দিকে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। দুইটার দিকে সিকিউরিটি গার্ড এসে বলেন, আগুন লেগেছে তাড়াতাড়ি বের হতে। তড়িঘড়ি করে কিছু না নিয়েই বের হই। যেখানে আগুন লেগেছে সেইখানে ছুটে যায়। দুই এক মিনিটের ভেতরে ফিরে এসে দেখি তাদের ওখানেও দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছুই নেই তাদের।

পাকা মার্কেটের নিচ তলায় মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিলেন একটি ফার্নিচার দোকানের মালিক সুমন। তার সঙ্গে কথা বলতেই তিনি জানান, প্রশাসন আমাদের হাতে না মেরে ভাতে মারছে। আমরা নিঃস্ব হয়ে গেলাম। এর চেয়ে আমাদের ক্রস ফায়ারে দিয়ে দিলেই ভালো করতো। ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন (৩৫) বলেন, তার বাবা ১৯৭২ সাল থেকে এই মার্কেটে ব্যবসা শুরু করেন। মার্কেটে তাদের তিনটি খাবারের দোকান ছিল, যার সবগুলোই পুড়ে ছাই।

তিনি বলেন, গতকালও আমি কোটিপতি ছিলাম। এখন রাস্তার ফকির। ডিসিসি (পাকা) মার্কেটের ১২১ নম্বর দোকানটিতে কার্পেটের দোকান ছিল ষাটোর্ধ্ব বাবর আলীর। দোকানে প্রায় ২৫ লাখ টাকার কার্পেট ও থান কাপড় ছিল বলে জানান তিনি। বলেন, আমার সব তো শেষ। কিছু মাল বের করতে পারছি, বেশির ভাগ মালই রয়ে গেছে। আগুন বাড়ছে। কী জানি হয়? ধোঁয়ার জন্য মালামাল বের করা যাচ্ছে না।

ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, অনেক আগে থেকেই কর্তৃপক্ষ তাদেরকে উচ্ছেদ করার জন্য চেষ্টা করছে। এ নিয়ে মামলাও চলছে। এই অগ্নিকাণ্ড একটি ষড়যন্ত্র বলে তারা মনে করেন। বলেন, এখানে এখন বহুতল ভবন হবে। কিন্তু আমাদের কি হবে? মার্কেটের এলপি গ্যাস ব্যবসায়ী মো. জাকারিয়া বলেন, তার দোকানটি কাঁচাবাজারের দোতলায়। সেখানে কয়েকটি গ্যাস সিলিন্ডার সরাতে পারলেও অন্তত ১০-১২ লাখ টাকার মালামাল সরাতে পারেননি। তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা প্রথম থেকে গাফিলতি করেছে। তারা যদি পাশের ঝিল থেকে পানির ব্যবস্থা করতেন তাহলে অল্প সময়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসতো।

অনুমতি ব্যতিত এই সাইটের কোনো কিছু কপি করা কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয়।

প্রিয় পাঠক অনলাইন নিউজ পোর্টাল দ্যামেইলবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন themailbdjobs@gmail.com ঠিকানায়।

More articles

সর্বশেষ

x  Powerful Protection for WordPress, from Shield Security
This Site Is Protected By
Shield Security