করোনাভাইরাসের জন্য দায়ী সার্স কোভ-২ ভাইরাসের জিনগত উপাদান বাংলাদেশের বর্জ্য পানিতে পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছেন গবেষকরা।
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (নোবিপ্রবি) এবং নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দলের নতুন এক গবেষণায় এমন তথ্যের প্রমাণ মিলেছে।
গত ২০ জুলাই থেকে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত সময় জুড়ে নোয়াখালীতে অবস্থিত একটি আইসোলেশন কেন্দ্রের আশপাশে কয়েকটি জায়গার ড্রেন থেকে বর্জ্য পানির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়েছে।
গবেষকদের একজন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির জিনোম রিসার্চ ইন্সটিটিউটের প্রধান ড. মুহাম্মদ মাকসুদ হোসেন বলছেন, ‘ধরুন একটা ছাকনির মতো যেখানে সংগ্রহ করা বর্জ্য পানির ভাইরাসগুলো আটকে যাবে, সেগুলোকে পরীক্ষা করা হয়েছে। ঠিক যেভাবে মানুষের শরীরের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করা হয় সেরকমই রিয়াল-টাইম পিসিআরে পরীক্ষা করে আমরা সংগ্রহ করা বর্জ্য পানিতে করোনাভাইরাসের কয়েকটি জিনের অস্তিত্ব পেয়েছি।’
তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণে ইতোমধ্যেই যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলো দিয়েই এই পরীক্ষা খুব কম খরচে করা হয়েছে।
‘একটি ফিল্টার যার দাম কয়েক হাজার টাকা, পরীক্ষার জন্য দরকারি রি-এজেন্ট পলিথাইলিন গ্লাইকনের জন্য আমাদের খরচ হয়েছে ১৫ হাজার টাকার মত। রিয়াল-টাইম পিসিআর মেশিন আছে, এমন যে কোনো ল্যাবে এই পরীক্ষা করা যাবে।’
করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারি শুরুর পর থেকে প্রতিদিন এই ভাইরাসটি সম্পর্কে নতুন নতুন নানা ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। করোনাভাইরাস বাতাস, হাঁচি, কাশির মাধ্যমে ছড়ায়।
ড. হোসেন বলছেন, পানি থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কোনো তথ্য এখনো জানা নেই। কিন্তু বর্জ্য পানিতে করোনাভাইরাসের জিন শনাক্ত হওয়ার বিষয়টি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে।
গবেষণা প্রতিবেদনটির নতুন দিক হলো- এখানে আইসোলেশন কেন্দ্রের একটি নির্দিষ্টসংখ্যক কোবিড রোগীর ‘জেনেটিক লোডকে’ তুলে ধরা হয়েছে। পৃথিবীতে এ সময়ে সম্পাদিত অনেক গবেষণার মতো এর মাধ্যমে কোনো দেশে কিংবা এর নির্দিষ্ট কোনো শহরে কী পরিমাণ কোভিড আক্রান্ত রোগী রয়েছে, তা অনুমান সম্ভব। করোনা আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগীর শরীরে কোনো উপসর্গ দেখা যাচ্ছে না, বা সামান্য উপসর্গ দেখা গেলেও তাদের হাসপাতালে না রেখে বাড়িতে রাখা হচ্ছে। সে কারণে নর্দমার বর্জ্য পানি থেকে এ ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কাও বাড়ছে। একটি এলাকায় করোনা আছে কি-না, তা জানতে ওই এলাকার সম্ভাব্য রোগীদের ওপর পরীক্ষার আগে সেখানকার ড্রেনের পানি পরীক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হতে পারে। এ গবেষণা প্রতিবেদনটির প্রাথমিক সাফল্য এখানেই।
এ বিষয়ে প্রথিতযশা ভাইরোলজিস্ট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, গ্যাস্ট্রো ইন্টেস্টাইনে কোভিড-১৯-এর অস্তিত্বের প্রমাণ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আমাদের দেশে ড্রেনের পানি তথা বর্জ্য পানিতে কোভিডের উপস্থিতি প্রমাণে গবেষকদের নতুন পদ্ধতিটি ভবিষ্যতে দেশে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। অধ্যাপক নজরুল ইসলাম একে উল্লেখযোগ্য অর্জন বলে মনে করেন।
নোবিপ্রবির অধ্যাপক ও গবেষক দলের প্রধান ড. ফিরোজ আহমেদ বলেন, যেহেতু সংক্রমিত কিংবা সংক্রমিত নয়Ñ উভয় ব্যক্তির শরীর থেকে নির্গত মলমূত্রের মাধ্যমেই ভাইরাস ছড়ায়। সুতরাং দেশে করোনা পরিস্থিতির সর্বশেষ পর্যবেক্ষণ এবং সংক্রমণের ওঠানামা সঠিকভাবে মূল্যায়নে বর্জ্য পানি নিরীক্ষণ একটি ফলপ্রসূ পদ্ধতি। আমাদের সংগৃহীত অনেক কোভিড-১৯ রোগীর মলে ‘ওআরএফ১ এবি’ এবং ‘এন প্রোটিন’ জিনসহ বেশ কয়েকটি জিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ফলে ড্রেন কিংবা নর্দমার বর্জ্য পানি পরীক্ষা করে কোনো এলাকায় করোনা আছে কি-না, তা জানা যেতে পারে।
গবেষক দলের অন্য সদস্যরা হলেন- নোবিপ্রবির অধ্যাপক ড. নেওয়াজ মোহাম্মদ বাহাদুর, সহকারী অধ্যাপক ফয়সাল হোসেন, মো. শাহাদাত হোসেন, আমিনুল ইসলাম, মো. মাইন উদ্দিন এবং নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জিনোম রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মোহাম্মদ মাকসুদ হোসেন, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব হেলথ অ্যান্ড লাইফ সায়েন্সের ডিন প্রফেসর হাসান মাহমুদ রেজা ও অধ্যাপক মো. জাকারিয়া।
এ গবেষণা কার্যক্রমে সার্বিকভাবে যুক্ত আছেন নোবিপ্রবির উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. দিদার-উল-আলম। তিনি বলেন, ড্রেনের পানি তথা বর্জ্য পানিতে কোভিডের উপস্থিতি প্রমাণে গবেষকদের নতুন পদ্ধতিটি আমাকে আনন্দিত ও উৎসাহিত করেছে। আশা করি এটি দেশে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে আমাদের একটি নতুন পথের সন্ধান দেবে।