আট বছর আগে সীমান্তরক্ষী বাহিনীতে সংঘটিত বিদ্রোহের (পিলখানা বিদ্রোহ) পেছনে স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র ছিল বলে উল্লেখ করেছেন আদালত। রোববার এই মামলায় হাইকোর্টের রায়ে এক বিচারকের পর্যবেক্ষণে এ কথা বলা হয়।
এতে আরও বলা হয়, এটি ছিল দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়াসহ স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপর প্রত্যক্ষ হুমকির বহিঃপ্রকাশ। নারকীয়, নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় সৃষ্টির মাধ্যমে বিডিআর সদস্যরা নিজেদের ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেছে।
তারা অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুণ্ঠন, গ্রেনেড বিস্ফোরণ, সশস্ত্র মহড়ার মাধ্যমে সন্ত্রাস ও জনজীবনে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। লাশ গুম, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতা বিনষ্টের চক্রান্তসহ নানাবিধ জঘন্য অপরাধ করে বিদ্রোহীরা।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নের লক্ষ্যে একটি স্বার্থান্বেষী মহলের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত বাহিনীকে ধ্বংসের চেষ্টা করা হয়।
এদিন চাঞ্চল্যকর পিলখানা হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায় পড়া প্রথম দিনের মতো শেষ হয়েছে। আজ পূর্ণাঙ্গ রায় পড়া শেষ হতে পারে। আসামি সংখ্যার দিক দিয়ে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এ মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে ভিন্নমত থাকলেও আদেশের অংশের বিষয়ে তিন বিচারপতিই একমত হয়েছেন। আদালত বলেছেন, সর্বসম্মত রায় হচ্ছে।
আজ সকালে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার তার পর্যবেক্ষণ ঘোষণা করবেন। এরপরই মূল রায় (আদেশের অংশ) দেয়া শুরু হবে।
রোববার সকাল ১০টা ৫৫ মিনিটে বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিশেষ বেঞ্চে মামলাটির রায় পড়া শুরু হয়। বেঞ্চের অপর দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার।
জনাকীর্ণ আদালতে বেঞ্চের নেতৃত্বদানকারী বিচারপতি মো. শওকত হোসেন প্রথমে রায় পড়া শুরু করেন। তার অল্প কিছু পর্যবেক্ষণ দেয়ার পরই বেঞ্চের অপর সদস্য বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী তার পর্যবেক্ষণ দেয়া শুরু করেন। দুপুর ১টায় মধ্যাহ্ন বিরতিতে যাওয়ার সময় রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামি পক্ষের আইনজীবীদের আদালত বলেন, এ রায়ের পর্যবেক্ষণই এক হাজার পৃষ্ঠার ওপরে। যে ভিত্তিতে রায় দেয়া হচ্ছে, তাও মৌখিকভাবে উপস্থাপন করা হবে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, পিলখানায় হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দেশে একটা ভয়াবহ ও ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছিল। ওই দিন ৫৭ জন মেধাবী সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে দেশের আইনের শাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা বিনষ্টের চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছিল বিডিআর সৈনিকরা। এমনকি বিডিআরের (বিজিবি) মহাপরিচালক ও তার স্ত্রীকেও হত্যা করা হয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও এত সংখ্যক সেনা কর্মকর্তা নিহত হননি। এটা ছিল নির্বিচারে হত্যা (মাস কিলিং)। দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়াসহ স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপর প্রত্যক্ষ হুমকির বহিঃপ্রকাশ এটি। নারকীয়, নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় সৃষ্টির মাধ্যমে বিডিআর সদস্যরা নিজেদের ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেছে। এ কলঙ্কের চিহ্ন বিডিআর জওয়ানদের বহুকাল বহন করতে হবে।
পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মামলার ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় সঙ্গত কারণেই আইন বিজ্ঞান, অপরাধ বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ, বিভিন্ন দেশে অপরাধের সাজা ও আইনের শাসন সম্পর্কে সংবিধানের নির্দেশনা বিবেচনার দাবি রাখে।
পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, এই মামলায় অভিযুক্তরা অপরাধ, ষড়যন্ত্র, নৃশংস হত্যাকাণ্ড, অমানবিক নির্যাতন, বাড়ি ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ করে। তারা অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুণ্ঠন, গ্রেনেড বিস্ফোরণ, সশস্ত্র মহড়ার মাধ্যমে সন্ত্রাস ও জনজীবনে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। লাশ গুম, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতা বিনষ্টের চক্রান্তসহ নানাবিধ জঘন্য অপরাধ করে বিদ্রোহীরা। ঘটনার ভয়াবহতা, নৃশংসতা, পৈশাচিকতা, বিশৃঙ্খলা, রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা বিনষ্টের চক্রান্ত ও সামাজিক নিরাপত্তাসহ সামগ্রিক বিবেচনায় এটি রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্র্ণ ফৌজদারি মামলা। এটা ফৌজদারি অপরাধ জগতে বিরল ঘটনা।
কত সময় লাগতে পারে আইনজীবীদের এমন প্রশ্নে বিচারপতি শওকত হোসেন বলেন, কখন শেষ হবে তা বলা যাচ্ছে না। একটা কথা বলতে পারি, সর্বসম্মত রায় হচ্ছে। সোমবার সকালে (আজ) বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার তার পর্যবেক্ষণ ঘোষণা করবেন। এরপরই মূল রায় (আদেশের অংশ) দেয়া শুরু হবে। আদালত বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে তৎকালীন ইপিআর বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত এ বাহিনী দেশে-বিদেশে সম্মানের সঙ্গে কাজ করেছে। কিন্তু ২০০৯ সালে পিলখানায় তৎকালীন বিডিআরের কিছু সদস্য আইনকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এই কলঙ্কচিহ্ন তাদের অনেক দিন বয়ে বেড়াতে হবে। একসঙ্গে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যার নজির ইতিহাসে নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ় মনোবল নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলায় যৌক্তিক পদক্ষেপ নিয়েছেন।
বিচারপতি মো. শওকত হোসেন তার পর্যবেক্ষণে বলেন, পিলখানায় হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দেশে একটা ভয়াবহ ও ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়। ওইদিন ৫৭ জন মেধাবী সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। দেশের সূর্যসন্তানদের হত্যা করা হয়। তাদের বিদেহী আত্মার প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি। তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতিও সমবেদনা জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, আমাদের দেশের বিচার বিভাগের জন্য এটা একটি ঐতিহাসিক মামলা। এ মামলার বিচারকালে বেশ কিছু আইনগত প্রশ্ন ওঠে। আপিল বিভাগে রাষ্ট্রপতি রেফারেন্স পাঠান। আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তের পর বিচার শুরু হয়। তিনি বলেন, মামলাটি আমাদের আদালতে আসার পর ৩৭০ কার্যদিবস শুনানি গ্রহণ করেছি। মামলার ৮৫০ জন আসামি শুধু এ রায় শোনার জন্য অপেক্ষা করছেন না, দেশের অনেকেই রায় জানতে চান। কেউ কেউ নির্ঘুম রাত কাটাবেন। তাই আমাদের দায়বদ্ধতা আছে। এটা অনেক বড় রায়। আমরা একটা ভালো রায় দেয়ার চেষ্টা করছি। তাই একটু ধৈর্য ধরতে হবে। আমাদের পর্যবেক্ষণ আলাদা আলাদা থাকতে পারে। তবে গন্তব্য এক। রায়ের আদেশের অংশের বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। এ রায় ঘোষণার জন্য আমাদেরও রক্তচাপ বেড়ে গেছে।
বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী তার পর্যবেক্ষণে বলেন, যুগান্তকারী এই মামলায় সাজা প্রদানে আমরা তিনজন বিচারক একমত হয়ে মামলাটি নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছি। নজিরবিহীন ঐতিহাসিক এই মামলায় পক্ষগণের যুক্তিতর্ক, আইনের ব্যাখ্যাসহ উচ্চ আদালতের নজির, মামলার প্রেক্ষাপট, পারিপার্শি^ক অবস্থা, ঘটনার গাম্ভীর্য, আসামি ও সাক্ষীর সংখ্যা, তদন্ত কার্যক্রম ও তর্কিত রায়ের বিশ্লেষণসহ দণ্ড ও সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে আমাদের অনুভূতি ও সার্বিক পর্যবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মনে করি। এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আজ (সোমবার) চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হবে বলে আশা করি।
তিনি বলেন, রায়ে কতজনের মৃত্যুদণ্ড, কতজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে, কার সাজা বহাল হবে, কাকে খালাস দেয়া হবে- সে বিষয়ে তিন বিচারপতিই একমত হয়েছেন। তিনি বলেন, রায়ের পর্যবেক্ষণে নারকীয় এ হত্যাকাণ্ডকে নৃশংস ও বর্বরোচিত বলে
উল্লেখ করা হয়েছে। আদালত বলেন, ৩০ ঘণ্টার বিদ্রোহে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তার হত্যার ঘটনা ছিল বর্বরোচিত ও নজিরবিহীন। যেখানে ১৯৭১ সালে ৯ মাসে স্বাধীনতা যুদ্ধে ৫৫ জন সেনা কর্মকর্তা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত হন। আফ্রিকার রুয়ান্ডা ও কঙ্গোর গৃহযুদ্ধে ১৭ জন, দক্ষিণ ফিলিপাইনে এক বিদ্রোহে ছয়জন, ১৯৬৭ সালে ইন্দোনেশিয়ায় ৭ দিনের বিদ্রোহে ১০০ জন নিহত হন বলে পরিসংখ্যানে পাওয়া যায়। পিলখানার ঘটনা এসব নজিরকে হার মানিয়েছে।
পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নের লক্ষ্যে একটি স্বার্থান্বেষী মহলের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত বাহিনীকে ধ্বংসের চেষ্টা করা হয়। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসীম ধৈর্য, বিচক্ষণতা, দৃঢ় সাহস ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়ে বিদ্রোহ দমনের যৌক্তিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন যা প্রশংসনীয়। তার রাষ্ট্রনায়কোচিত দৃঢ় পদক্ষেপ অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে।
অন্যদিকে আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা, দেশের সার্বভৌমত্ব, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিমান ও নৌবাহিনী পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছে। দেশের সংবিধান ও গণতন্ত্রের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও অবিচল আস্থা রেখে চরম ধৈর্যের সঙ্গে উদ্ভূত ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি মোকাবেলা করে তারা দেশের মানুষের ভালোবাসা ও সুনাম অর্জন করেছে। বাংলাদেশ রাইফেলসের ২১৮ বছরের ইতিহাস, স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের (ইপিআর বাহিনী হিসেবে) অসামান্য ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রায়ে তুলে ধরা হয়।
এতে বলা হয়, ২১৮ বছরের অধিককালের ঐতিহ্যবাহী আধাসামরিক বাহিনী হিসেবে বিডিআরের নেতৃত্ব শুরু থেকেই সেনাবাহিনীর হাতে ছিল। ফলে সাধারণ জওয়ান ও সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে মর্যাদা, শৃঙ্খলা ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে ক্রমান্বয়ে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। ফলে বিডিআর সদস্যদের মধ্যে সেনা অফিসারদের কর্তৃত্ব মেনে না নেয়ার এক প্রচ্ছন্ন মানসিকতা নীরবে সক্রিয় ছিল। ওই ঔদ্ধত্যপূর্ণ মানসিকতায় বিডিআরের বিভাগীয় কতিপয় উচ্চাভিলাষী সদস্যের প্ররোচনায় ও উসকানিতে সাধারণ ও নবাগত সৈনিকরা প্ররোচিত ও বিভ্রান্ত হয়েছে।