ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ন্যায্য মূল্যের পণ্য কালোবাজারে পাচার হওযার ঘটনা ঘটেই চলেছে। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের এ সময়ে দেশ যখন সংকটকাল পার করছে তখন একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী, ডিলার ও টিসিবির কর্মকর্তাদের যোগসাজশে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য খোলাবাজারে বিক্রি করতে বরাদ্দ পণ্য কালোবাজার চলে যাচ্ছে। এ বিষয়ে টিসিবির কোনো তদারকিই নেই। অন্য কোনো সরকারি সংস্থার কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ পেলেই কেবল ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
এদিকে করোনা রোধে শারীরিক দূরৎব বজায় রাখার সরকারি নির্দেশনা মানা হচ্ছে না টিসিবির ট্রাকে পণ্য বিক্রির সময়।
টিসিবির হিসাবে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১৭ দিনে কালোবাজারে পণ্য পাচারের ২০টি ঘটনা তারা পেয়েছে। সর্বশেষ গত বুধবার রংপুর শহরের মধ্যপার্বতীপুর এলাকার হানিফ মিয়ার বাড়ির খাটের নিচ থেকে টিসিবির এক হাজার ২৩৮ লিটার সয়াবিন তেল জব্দ করে মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। ওই ঘটনায় দুজনকে আটক করা হয়েছে।
এর আগে ১ এপ্রিল ঝালকাঠিতে টিসিবির পণ্য কালোবাজারে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে মজুদ করায় তিন ডিলারকে ২৮ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। বেশি পরিমাণে পণ্য মজুদ করায় রুবেল ট্রেডার্সের ডিলারশিপ বাতিলের সুপারিশ করা হয়। এরপর গত ৬ এপ্রিল রাতে রংপুর নগরীর বাবুপাড়া এলাকায় খালেক মিয়ার গুদাম থেকে ৩৬৪ লিটার সয়াবিন তেল, দুই হাজার ৩৫০ কেজি চিনি, ১০ বস্তা মসুর ডাল এবং ২৫০ কেজি পেঁয়াজ আটক করা হয়। টিসিবি রংপুর কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক সুজা ওই সময় জানিয়েছিলেন, খালেক মিয়া নামে টিসিবির কোনো ডিলার নেই।
গত ১১ এপ্রিল টিসিবির পণ্য কালোবাজারে বিক্রির দায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার রামপুর বাজারের ডিলার মুজাহিদুল ইসলামকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। এ ছাড়া তাঁর গুদাম সিলগালা করে দেন। ৯ এপ্রিল উপজেলার কৃষ্ণরামপুর বাজারে টিসিবির পণ্য কালোবাজারে বিক্রির সময় স্থানীয় লোকজন ৪৬ লিটার সয়াবিন তেলসহ দুজনকে আটকের পর ওই অভিযান চালানো হয়। এরপর ১৩ এপ্রিল একই অভিযোগে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার মুলাডুলিতে ডিলারসহ দুজনকে আটক করে পুলিশ। এ সময় টিসিবির পাঁচ বস্তা চিনি, দুই বস্তা মসুর ডাল ও চার বস্তা ছোলা বিক্রির জন্য মজুদ করে তারা। গত ১৪ এপ্রিল নড়াইল শহরের রূপগঞ্জ বাজারের টিসিবির ডিলার পরিতোষ কুণ্ডু ও সদর উপজেলার নাকশী বাজারের ব্যবসায়ী লিটন শিকদারকে আটক করা হয়। জব্দ করা হয় টিসিবির ১৮ বস্তা চিনি এবং ২৪ বস্তা ছোলা (প্রতি বস্তায় ২৫ কেজি)।
ট্রাকে করে টিসিবির পণ্য বিক্রি সরেজমিনে ঘুরে এবং গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, টিসিবি ডিলারদের কেউ কেউ ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করার জন্য পণ্য উত্তোলন করেই সরাসরি কালোবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। অনেক ডিলার টিসিবি থেকে পণ্য উত্তোলন করে ট্রাকে করে বিক্রি করার আগে অর্ধেক পণ্য সরিয়ে ফেলছে এবং কালোবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। গ্রাহকরা অভিযোগ করেছে, ডিলাররা যখন পণ্য নিয়ে ট্রাকে করে বিক্রি করতে আসে তখন বরাদ্দ করা পুরো পণ্য আনা হয়েছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে না। টিসিবির কিছু অসাধু কর্মকর্তা এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে বলে গ্রাহকদের সন্দেহ।
টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আমাদের নিজেদের কোনো তদারকি বা তদন্ত টিম নেই। তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে যদি কোনো লিখিত অভিযোগ বা সুপারিশ আসে তবে আমরা তার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিই। সাধারণত ডিলারদের বিষয়ে অভিযোগ এলে আমরা শোকজ করি, প্রয়োজন মনে করলে জামানত (১৫ হাজার টাকা) বাতিল করি। অভিযোগের ভিত্তিতে ডিলারশিপ বাতিলও হয়।’ ১৫ থেকে ১৭ দিনে এমন ২০টির মতো অভিযোগ পাওয়া গেছে এবং ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান। তবে সর্বোচ্চ কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা তিনি বলতে পারেননি।
হুমায়ুন কবির আরো বলেন, ‘জেলা পর্যায়ে আমাদের কাজ করেন তিনজন কর্মকর্তা। এই জনবল দিয়ে কী করে নিজেরা তদারকি করব।’ পণ্য বিক্রির সময় শারীরিক দূরত্বের বিষয়টি মানা হচ্ছে না স্বীকার করে তিনি বলেন, এ বিষয়ে ডিলারদের নির্দেশনা দেওয়া আছে। কোথাও কোথাও ব্যানারে লেখা থাকে, বৃৎত করে দেওয়া হয়। কিন্তু তার পরও ক্রেতাদের মানানো যাচ্ছে না। ঢাকার বাইরের চেয়ে ঢাকায়ই নির্দেশনা উপেক্ষা বেশি হচ্ছে বলে মনে করছেন তিনি। হুমায়ুন কবির বলেন, ‘পরিদর্শন করে যতটুকু দেখেছি, ঢাকার মধ্যেই ১০০ ট্রাকের ৫০টিতেই গ্রাহকদের এ নির্দেশনা মানানো যাচ্ছে না।’
সুত্র : কালেরকন্ঠ