রবিবার, মে ২৬, ২০২৪

আমার দেখা ওয়ান ইলেভেন (পর্ব-২)

যা যা মিস করেছেন

সস্তার ২ রুমের ১টা ছোট্ট বাসা নিলাম। খরচ, কীভাবে চলবে সব হিসাব করছিলাম। জসীম ভাই থেকে ১০,০০০ ডলার ধার নিলাম। প্রতিমাসে রাকামনির জন্যে ৫০০ ডলার child tax benefit পাচ্ছি। বাচ্চার স্কুলের বেতন, চিকিৎসা খরচ একেবারে নেই। ৩ জনের তখনকার দিনে খাওয়া খরচ ১০০-১৫০ ডলার। বাস ও ট্রেনের (TTC) মাসিক টিকিট কার্ড ১০০ ডলার। ওই কার্ড আমি আর নাসিম ভাগ করে ব্যবহার করতাম। একদিন টিভিতে শুনি দুর্নীতিবাজের ২য় ৫০ জনের তালিকা বের হল। সেখানে নাসিমেরও নাম আছে। শুনে ভীষণ আতঙ্ক হলো।

আমি যদিও তখন বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে MD Course এ ছিলাম। তবুও ভাবলাম ডাক্তার হিসেবে কানাডাতে রেজিস্ট্রেশন করি। শুরু হল UofT এর লাইব্রেরিতে পড়াশোনা। ইমিগ্রেন্ট ডাক্তারদের ১টা গ্রুপ হল। ১/২ জন ভারত, সোমালিয়া, শ্রীলঙ্কার ডাক্তার বান্ধবীর গ্রুপ হল। ঠিক হলো আমরা জানুয়ারি ২০০৮ এ ডাক্তারদের evaluation exam এ বসব। বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে আমাকে চাকুরির পরামর্শ দিচ্ছিল। কিন্তু আমার মধ্যে দ্বিধা ছিল আমি কি কানাডায় থাকব নাকি দেশে ফিরে যাব। পরে আমি এপার্টমেন্টের কাছে ডলারের দোকানে গেলাম চাকরি খুঁজতে। কিন্তু তারা পার্টটাইম কাউকে নেবে না।

তার ২-১ দিন পরই এক বান্ধবীর জন্মদিনের দাওয়াত পেলাম। রেলস্টেশনে ১টা দোকানে সেল দিচ্ছিল সেখান থেকে আমি ১ জোড়া ফুলদানি এবং ১ টা মোমবাতি মোট ১০ ডলার দিয়ে কিনে ফেললাম। বাসায় এসে নাসিমকে বললাম দেখো কি সুন্দর জিনিসগুলো মাত্র ১০ ডলারে পেয়ে গেলাম। সে গম্ভীর হয়ে বলল, কেন নিলে এগুলো? বললাম এত ঠাণ্ডার দেশে তো ছোট্ট ঘর থেকে রান্নার গন্ধ যায় না। সুগন্ধি মোমবাতি দুর্গন্ধ দূর করবে। আর ফুলদানি তো উপহার দেব। তখন কেন যেন নাসিম হঠাৎ ভীষণ রেগে গেল। আমার এখানে টানাটানি যাচ্ছে আর উনি মোমবাতি কেনে। কেঁদে কেটে বলেই ফেললাম আমি বাংলাদেশে চলে যাব। (সেই ফুলদানি জোড়া ১/১১ এর স্মৃতি হিসেবে বেডরুমে রেখে দিয়েছি।)। পরে নাসিম ১টা কলেজে কোন কোর্সে যেন ভর্তি হতে গেল। পড়াশোনা করলে নতুনদের এই দেশ উল্টো সংসার খরচের টাকা দেয়। কিন্তু কোর্স শুরু হতে দেরি হল। তাই নাসিম সেখানে বাইন্ডারের কাজ নিল। কাগজের ধারে মাঝে মাঝে তার হাত কেটে যেত। একদিন তো বেচারা বরফের উপর হাঁটতে যেয়ে ধপাস করে পড়ে গেল। জসিম ভাই তাঁর গাড়ি নিয়ে walk in clinic এ নিয়ে গেলেন। ২ দিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হল।
দেশে আসার সময় রাকার ভীষণ কান্না, ‌‘না আমি, এই দেশে আব্বুর সাথে থাকব। তুমি তোমার MD Degree সামলাও।’ ক্লাস সেভেনের ১টা মেয়েকে শুধু বাবার ভরসাতে কীভাবে রাখি? এদিকে প্লেনের বোর্ডিং গেইটে সুবীরদা আর শহীদ ভাইয়ের সাথে দেখা। বললেন, ‘ভাবি, ভালই হল একই ফ্লাইটে আমরা।’ আমি শুধু দোয়া পড়ে যাচ্ছি। মুখে ‘হ্যা’ ‘না’ শুধু বললাম। আমার এই দুই ভাই ট্রানজিটেও অনেক আন্তরিকতা দেখালেন। আমি কিছুই বললাম না। ঢাকা বিমানবন্দরে এসে তাঁদের দুজনের সামনে দিয়ে আমি আর রাকা হনহন করে বের হয়ে গেলাম। সুবীরদা “ভাবি ভাবি” ডাকলেও একদম ফিরে তাকাইনি। এটা নিয়ে দাদা সারাজীবন খোঁচা দিয়ে গেলেন। কিন্তু আমি চাইনি এয়ারপোর্টে কোন সিন তৈরি হোক, তাঁদের দুজনের সাথে দুর্নীতির সূত্র খুঁজুক কিংবা কেউ না জানুক আমি দেশে।

দেশে আসার ৪/৫ দিন পর বিকেলে এক ভদ্রলোক আসলেন, পরিচয় দিলেন দুদকের উপপরিচালক। তারপর নিজের স্বাক্ষর করা কাগজ আমার হাতে দিলেন। তাতে লিখা ছিল,
আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধূরী আপনি এবং আপনার স্ত্রী অমুক দিন সংসদ ভবনস্থ Taskforce 27 এ দেখা করুন। লোকটা বলল, বুঝলেন শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়া যেখানে বন্দি, তার মাঝের বিল্ডিংয়ে যাবেন। শুনে মেজাজ খারাপ হলেও বললাম, ‘আমি তো একা যেতে পারব না। আমার দেবর কিংবা বাবাকে নেব।’ অনেক অনুরোধে রাজি হল। ধানমন্ডির ছোট ফ্ল্যাটটা ঘুরে দেখে হতাশ হলেন। বললেন, বাসা কি এতটুকুই নাকি ওইপাশেও যেতে পারব। তখন জবাব দিলাম পাশের ফ্ল্যাটে যেতে হলে এই ফ্ল্যাট থেকে বের হতে হবে।
তারপর শুরু হল বাসায় কান্নাকাটি, আম্মু আর আম্মা দুজনই কেঁদে বলেন, মানা করেছিলাম দেশে আসতে, তবুও কেন আসলে? এই ডিগ্রি না হলে কি হত? নাসিম শুনে সেও কেঁদেছিল।

চলবে…

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

লেখক : অধ্যাপক, কার্ডিওলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

অনুমতি ব্যতিত এই সাইটের কোনো কিছু কপি করা কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয়।

প্রিয় পাঠক অনলাইন নিউজ পোর্টাল দ্যামেইলবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন themailbdjobs@gmail.com ঠিকানায়।

More articles

সর্বশেষ

x  Powerful Protection for WordPress, from Shield Security
This Site Is Protected By
Shield Security