সন্তানের পরিপূর্ণ শারীরিক আর মনোসামাজিক বিকাশে বাবা-মায়ের ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেউ কেউ বলে থাকেন ‘বাবা-মায়ের আবার ধরন কী’, ‘বাবা-মা মানেই বাবা-মা’। কথাটি বিজ্ঞানসম্মত নয়। ভালো ও আদর্শ মা-বাবা হওয়ার জন্য কত চেষ্টা থাকে। সব মা-বাবা সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যত্ চান। অনেক সময় তাঁরা নিজেদের অজান্তে এমন কিছু করে ফেলেন, যা সন্তানের জন্য মঙ্গলজনক হয় না। মা-বাবার চিন্তা ও আচরণের ওপর ভিত্তি করে চারটি ধরন দেখা যায়:
১. কর্তৃত্বপরায়ণ (অথরেটেরিয়ান)।
২. পারমিসিভ (সন্তানকে কোনো নিয়মের মধ্যে রাখতে পারে না, একেবারেই সন্তানের সব ইচ্ছার কাছে নতিস্বীকার করে)।
৩. আনইনভলব (সন্তানের ভালো-মন্দ কোনো দিকেই নজর দেয় না, সন্তানের সঙ্গে একরকম দূরত্ব থাকে)।
৪. অথরেটেটিভ (এই ধরনের বাবা-মায়েরা শাসন ও স্নেহের ভারসাম্য রেখে চলেন, সন্তানকে নিয়মের মধ্যে রেখে তাকে পর্যাপ্ত স্বাধীনতা দেন, যা সন্তানের সুস্থ বিকাশের সহায়ক)।
এই চার ধরনের মধ্যে শেষের ধরনের বাবা-মায়েরা আদর্শ বাবা-মা। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, কোনো বাবা-মা সব সময় একটা ধরনের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতে পারেন না। পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে তাঁরাও মাঝেমধ্যে অযাচিত আচরণ করে ফেলেন, যা সন্তানের জন্য ক্ষতিকর। সন্তানের বিকাশে মা-বাবার ভালো আচরণ যাকে আমরা বলি ‘গুড প্যারেন্টিং’। তার জন্য বাবা-মাকে যে বিষয়গুলোর দিকে লক্ষ রাখতে হবে:
# ভালো বাবা-মা হতে হলে আগে ভালো স্বামী-স্ত্রী হতেই হবে।
# সন্তানের সামনে বাবা-মা একে অন্যকে তাচ্ছিল্য বা অপমান করবেন না। ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি তো নয়ই।
# সন্তানকে ভালোবাসা শেখাতে হলে সন্তানের পাশাপাশি আপনার স্ত্রী বা স্বামীর প্রতি ভালোবাসা দেখান, সন্তান যাতে বুঝতে পারে তার বাবা-মা পরস্পরকে ভালোবাসেন।
# সন্তানের সামনে পরিবারের অন্য সদস্য, তার শিক্ষক, সহপাঠী বা গৃহকর্মীর সমালোচনা বা তাদের প্রতি বিরূপ আচরণ করবেন না।
# স্কুলগামী সন্তানের স্কুলের বই শিশুকেই পড়তে দিন। আপনি তার পড়ার বই মুখস্থ করবেন না। স্কুলের বই–ব্যাগ তাকেই সাজাতে দিন। স্কুল থেকে সে যেন নিজের পড়া নিজেই তুলে নিয়ে আসে। তার বই-ব্যাগ গোছানো থেকে বিরত থাকুন, স্কুলের পড়া আপনি সংগ্রহ করবেন না।
# সন্তানের দৈনন্দিন কাজের দায়িত্ব দুজনকে ভাগ করে নিতে হবে। এ নিয়ে একে অন্যকে দোষারোপ করবেন না।
# সন্তানের সঙ্গে খেলুন, তাকে যতটুকু সময় দেবেন, তা যেন খুব গুণগত হয়।
# সন্তানের ছোটখাটো দোষ-ত্রুটিকে বড় করে দেখবেন না, কথায় কথায় সন্তানকে তাচ্ছিল্য, তুলনা করবেন না।
# পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠ কেউ থাকলে (দাদা, নানা, দাদি, নানি) তাঁদের প্রতি বাবা-মাকে পর্যাপ্ত সম্মান দেখাতে হবে, অন্যথায় সন্তানের মনে শ্রদ্ধাবোধ জন্ম নেবে না।
# বাবা-মাকে নৈতিক দিক থেকে শক্ত হতে হবে। সন্তানের কাছে বাবা-মা সব সময় এক আদর্শ মডেল বা সুপার হিরো। একটা সময় যদি সন্তান আবিষ্কার করে তার বাবা-মা একজন দুর্নীতিপরায়ণ বা অসত্, তখন তার মনে তীব্র দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। সে বিষণ্নতা, মাদকাসক্তি নানা সমস্যায় আক্রান্ত হয়।
# রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নিয়ম মেনে চলুন, তাহলে সন্তানেরা আপনাকে অনুসরণ করে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে।
# বাড়িতে সুস্থ বিনোদনচর্চার চেষ্টা করুন, বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। কেবল ইলেকট্রনিক গেজেটে দিয়ে সন্তানকে খুশি করার চেষ্টা করবেন না, বিনোদনের অন্যান্য মাধ্যমের সঙ্গে তাকে পরিচিত করান।
# সন্তানের কোনো বিষয় নিয়ে মতানৈক্য হলে নিজেরা বিবাদে লিপ্ত না হয়ে একসঙ্গে সিদ্ধান্ত নিন।
# সন্তানের কোনো অপরাধ একে অন্যের কাছে গোপন করবেন না। বিষয়টি সংশোধনের জন্য সন্তানকে বুঝিয়ে বলুন।
# সন্তানকে নিয়ম মেনে চলতে বলে নিজেরা নিয়মের বাইরে থাকবেন না।
# সন্তান লালনে নিজেদের কোথাও সমস্যা হচ্ছে মনে করলে পেশাদার বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিতে পারেন।