এ ঘটনায় দিশেহারা হয়ে পড়েন ফাওজিয়ার মেয়ে শুহরা কুফি। দু’বারের পার্লামেন্ট সদস্য ফাওজিয়াকে ফেরাতে পারবেন কিনা সে বিষয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন শুহরা। তিনি বলেন, আমি নিজেকে শান্ত করে মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। কারণ জীবনে ফেরার জন্য আমাকে তার প্রয়োজন ছিল।
মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফেরা
গত ১৪ আগস্ট শুহরার মা আফগানিস্তানের পারওয়ান প্রদেশ থেকে রাজধানী কাবুলে ফিরছিলেন। ফেরার পথে তারা খেয়াল করেন, দু’টি গাড়ি তাদের গাড়িকে ফলো করছে। বুঝতে পারছিলেন তাদের সামনে বিপদ।
শুহরা বলেন, হামলার ঠিক আগে একটি কালো গাড়ি আমাদেরকে ওভারটেক করে সামনে চলে আসে। আমাদের ড্রাইভার তাদের লক্ষ্য করে হর্ন বাজায়। হঠাৎ খেয়াল করি পেছনের গাড়ি থেকে মা যে পাশে বসা ছিলেন সেদিকে গুলি করা হচ্ছে। প্রথম গুলিটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।
গাড়ির পেছনের সিটে মায়ের পাশেই বসা ছিলেন শুহরা। তিনি মাকে জড়িয়ে ধরে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। কোনক্রমে তারা প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছেন।
এর আগে ২০১০ সালে আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত নাঙ্গারহার এলাকা সফর করছিলেন ফাওজিয়া এবং শুহরা। সেসময় ফাওজিয়া ছিলেন পার্লামেন্ট সদস্য। সেই সময়কার প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল ফাওজিয়ার।
ওই সফরে ফাওজিয়া একটি গাড়ী বহরে চলছিলেন। সেসময় শুহরার বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর। সেই সফরে গাড়িবহরে বৃষ্টির মতো গুলি ছোঁড়া হয়। ঘটনাস্থলে পুলিশ হাজির হয়। তাদেরকে উদ্ধার করে আকাশপথে কাবুলে পাঠানো হয়।
অক্ষত অবস্থায় সেবার বেঁচে যান ফাওজিয়া। তালেবানরা ওই হামলার দায় স্বীকার করে। শুহরা বলেন, সে সময় হামলার বিষয়টি মেনে নেয়া সহজতর ছিলো। কারণ আমরা জানতাম কারা হত্যাচেষ্টা করেছে। দ্বিতীয়বারের হামলার দায় স্বীকার করেনি কেউ। হামলাকারী আমাদের অচেনা। সেই কারণে আমাদের পরিবারের কাছে এটি জটিল ও ভীতিকর পরিস্থিতি।
ফাওজিয়ার মতো তার দুই কন্যাও ভয়াবহ সংঘাতপূর্ণ অবস্থা দেখে বড় হয়েছে। কোন কোন সংঘর্ষে নিজের স্বজন হারিয়েছেন তারা। শুহরার নানাও পার্লামেন্ট সদস্য ছিলেন। জঙ্গীরা তাকে হত্যা করে।
শুহরার বাবা যক্ষায় মারা যান। তার আগে তালেবানরা দীর্ঘদিন তাকে কারাগারে আটকে রাখে। বাবার মৃত্যুর সময় শুহরা অনেক ছোট ছিল।
ফাওজিয়া একাই তার দুই মেয়েকে বড় করেছেন এবং পাশাপাশি রাজনীতি করেছেন। শুহরা বলেন, আমরা কখনও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারিনি। ভয়ে ভয়ে থেকেছি কখন কাকে হারাতে হয়।
শুহরা জানান, গত আগস্টে দ্বিতীয় হামলার পর মা আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, আমি মনে হয় গুলিবিদ্ধ। সেটা এমন একটা পরিস্থিতি ছিলো যেটা জীবনে ভোলা সম্ভব নয়।
এর পর থেকে ফাওজিয়া ছিলেন বাকরুদ্ধ। একটি বুলেট গাড়ীর পেছন দিক দিয়ে প্রবেশ করে ফাওজিয়ার ডান কাঁধের নীচে বাহুতে ঢুকে যায়। শুহরা বলেন, আমি ধরেই নিয়েছিলাম মাকে ফেরাতে পারবো না। কথা বলে বলে তাকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করছিলাম।
ওই হামলার আগে ফাওজিয়া কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছিলেন। করোনামুক্ত হলেও তিনি আয়রন ঘাটতিতে ভুগছিলেন।
গুলিবিদ্ধ হওয়ার ৪০ মিনিট পর তারা হাসপাতালে পৌঁছান। বুলেট খুঁজে বের করতে দু’বার সিটি স্ক্যান করতে হয়। এক সপ্তাহ চিকিৎসার পর ফাওজিয়া বাসায় ফিরেছেন।
তালেবানদের কড় সমালোচক ফাওজিয়া
ফাওজিয়া কুফি আফগান নারীদের বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন সবসময়। কিন্তু তার কণ্ঠকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। গত বছর তালেবানদের সঙ্গে যখন আলোচনা শুরু হয় তখন ফাওজিয়া নারী প্রতিনিধিদেরও অন্তর্ভুক্ত করার দাবী জানান। তার এ প্রস্তাবকে উপহাস করে তালেবান প্রতিনিধিরা।
সরকার এবং তালেবানদের মধ্যে শন্তি আলোচনায় সক্রিয় থেকেছেন ফাওজিয়া। এ সপ্তাহে সে আলোচনা আবারো শুরু হওয়ার কথা। তিনি আশঙ্কা করেন, যারা চায় না তিনি আলোচনায় থাকুন তারা আগস্টের হামলার পেছনে থাকতে পারে।
তালেবানরা অবশ্য এ হামলায় সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করেছে। যে এলাকায় ফাওজিয়ার উপর হামলা হয়েছে সেই অঞ্চলে আরেকটি সন্ত্রাসী দল সক্রিয় আছে।
আগস্টের হামলার পর থেকে ট্রমার মধ্যে আছেন শুহরা আর তার মা। ফাওজিয়া ধারণা করতে পারছেন না, তার দেশের মানুষই তাকে হত্যার চেষ্টা করছে! অথচ তিনি সবসময় জনগণের জন্য কাজ করে চলেছেন।
আফগানিস্তান সবসময় নারীদের জন্য বৈরী। এ দেশে নারী রাজনীতিবিদরা নানা বাধার সম্মুখীন হন। ২০১৮ সালে ফাওজিয়া এবং তার বোনকে নির্বাচন করতেই দেয়া হয়নি। জঙ্গীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা আছে এই অভিযোগ এতে তাদেরকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা হয়।
শুহরা জানে, নারীদের অনেক প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে হবে। এসব জেনেবুঝেই মায়ের পথে হাঁটছেন শুহরা। মায়ের উপর একাধিক হামলার পরও রাজনীতিতেই ক্যারিয়ার গড়তে চান তিনি।