শনিবার, মে ৪, ২০২৪

সুবেদার ইসলাম খান ঢাকাতে সুবে বাংলার রাজধানী নির্মাণ করেন

যা যা মিস করেছেন

ঢাকা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন শহর। এমনকি সহস্র বছরের প্রাচীনত্ব রয়েছে ঢাকার। হাজার বছর থেকেই এখানে নগরপত্তন শুরু হয়েছিল, তার চিহ্ন, দস্তাবেজ, দালিলিক রূপ-অনেক কিছুই এখনও আছে। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বের বৃহত্তম ১২টি শহরের মধ্যে একটি ছিল ঢাকা। আবার ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘ বিশ্বের ৫০টি সেরা শহরের তালিকা করেছিল। ঢাকার স্থান এতে রয়েছে ২২ তম স্থানে। ঢাকা কেবল একটি শহর নয়, এটি আমাদের গৌরব ও ভালোবাসার উৎস হয়ে আমাদের সঙ্গ দেয় প্রতিনিয়ত। এ জন্যই বলতে হয়-

ঢাকা আমার ঢাকা

তোমার কাজ কি আমাকেই শুধু শাশ্বতে ধরে রাখা?

১৬১০ সালে (মতান্তরে১৬০৯) সুবেদার ইসলাম খান ঢাকাতে সুবে বাংলার রাজধানী নির্মাণ করেন। প্রথমে ঢাকা ছিল কতগুলো গ্রামের সমষ্টি। রাজধানী হওয়ার পর গ্রামগুলো মিলেমিশে শহরে পরিণত হয়। মোগল যুগে ঢাকা নগর বিকশিত হয় চকবাজার ও আফগান দুর্গকে (বর্তমানে কেন্দ্রীয় কারাগার) কেন্দ্র করে। আশপাশের জায়গাগুলো গড়ে উঠতে থাকে শিল্প, বাণিজ্য ও প্রশাসনিক এলাকা হিসেবে, দুর্গ ঘেঁষে গড়ে ওঠে সমাজের উচ্চ শ্রেণির মানুষের আবাসিক এলাকা। মোগল উজির, ওমরাহ, আমলাদের বাসস্থান ছিল বকশীবাজার। আফগান দুর্গটি ছিল একটি প্রাসাদ। অন্যান্য ক্ষমতাধর মানুষেরা বাস করতো বেচারাম দেউড়ি, আগাসাদেক দেউড়ি, আলী নাকোই দেউড়ি এবং আমানত খান দেউড়িতে। হস্তশিল্প নগরী হয়ে ওঠে শাঁখারি বাজার, পাটুয়াটুলী, কুমারটুলী, তাঁতিবাজার, লক্ষ্মীবাজার, বানিয়া নগর, সূত্রাপুর ইত্যাদি এলাকা। ঢাকা এভাবেই মোগল শাসন আর গ্রামীণ অর্থনীতির ভেতর দিয়ে বিকশিত হতে থাকে নতুন নগররূপে।

১৭১৫ মতান্তরে ১৭১৬ সালে মুর্শিদকুলী খান বাংলার সুবেদার হওয়ার পর মুর্শিদাবাদ বাংলার নতুন রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে। এর পরেই ঢাকা নগরের গুরুত্ব অনেক কমে যায়।

উনিশ শতক থেকে বিশ শতকরণে চল্লিশের দশক পর্যন্ত ঢাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ ছিল সীমিত। উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে ঢাকায় পাট উৎপাদনকে ঘিরে কিছু কারখানা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণের ফলে ১৮৫০ এর দশককে মোটামুটিভাবে শহরের অবক্ষয়ের শেষ কাল এবং এর আয়তনের নব রূপায়ণের সূচনাকাল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

১৮৪০ এর দশকে রমনা এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়। অনেকেই পুরানো ঢাকা ছেড়ে এ এলাকায় বাস করতে আসেন। রমনা এলাকা পরিষ্কার করা ছাড়াও নতুন একটি ক্যান্টন বা সেনানিবাস তৈরির উদ্দেশ্যে নওয়াবপুর ও ঠাঠারীবাজার ছাড়িয়ে শহরের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত অনেকখানি জায়গা সংস্কার করেন। আর এখানেই স্থানান্তর করা হয় তেজগাঁও এলাকার বেগুনবাড়ি সেনানিবাসটি।

এ এলাকাটিই বর্তমানে সাধারণভাবে পুরানো পল্টন নামে পরিচিত। ১৮৮৫ সালের আগের শহরের উত্তরাংশের আর তেমন বিস্তৃতি ঘটেনি। সে বছর ফুলবাড়িয়ার কিছু অংশ ঢাকার প্রথম রেলস্টেশন স্থাপনের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়। স্টেশন কর্মচারীদের বাসগৃহ এবং রেলওয়ে ওয়ার্কশপের জন্য প্রায় ৫০ একর জমি নেওয়া হয় এবং এই এলাকাকে ঘিরে খুব দ্রুত গড়ে একটি রেলওয়ে কলোনি। ১৯০৫ সালের অক্টোবরে নতুন প্রদেশ পূর্ববঙ্গ ও আসামের রাজধানী হওয়া পর্যন্ত ঢাকার এদিক আর তেমন বিস্তৃতি ঘটেনি।

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ঢাকা পূর্ব ও পশ্চিম উভয়দিকে সম্প্রসারিত হয়। অতীতে জনবিরল হয়ে যাওয়া পূর্বদিককার গেগুারিয়া, নারিন্দা এবং আলমগঞ্জ এলাকায় আবার জনবসতি গড়ে ওঠে। পশ্চিমদিকে এনায়েত হাজারীবাগ এবং নওয়াবগঞ্জ শহরের নতুন সম্প্রসারিত এলাকা হিসেবে গড়ে ওঠে। ১৮৮১ সালে ‘দ্য বেঙ্গল টাইমস’ উল্লেখ করে যে, ‘যারা অর্ধযুগ বা আরও কিছু বেশি সময় ধরে ঢাকা শহরকে দেখেননি তারা শহরের সর্বত্র স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান উন্নতি আর অগ্রগতি দেখে বিস্মিত হবেন।’

১৮৮৯ সালে ঢাকা পরিদর্শনের পর বাংলার ম্যালিটারী কমিশনার ডা. উইলিয়াম হেনরী গ্রেগ (Dr. Willim Henry Gregg) মন্তব্য করেছিলেন যে, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শহরটি পশ্চিম দিকে সম্প্রসারিত হয়েছে এবং উনিশ শতকের ধারণায় শহরে যেসমস্ত নতুন বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট নির্মিত হয়েছে, সেগুলোর সাথে লক্ষণীয় বৈসাদৃশ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মধ্যযুগের পুরানো ঢাকা।’

সমসাময়িককালে পরিপূর্ণ পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা হিসেবে যে একটি মাত্র অঞ্চল গড়ে উঠেছিল তা হচ্ছে ওয়ারী, ঠাঠারীবাজারের দক্ষিণ-পূর্বে এবং ইংরেজদের কবরস্থানের (Cemetery) উত্তর–পশ্চিমে ওয়ারী মৌজাটি ছিল প্রায় ২৭ একরের একটি খাস মহল। ১৮৮৫ সালে ঢাকার কালেক্টর ফ্রেসরিক উয়্যার এলাকাটির উন্নয়নে বিশেষ আগ্রহ দেখান। সমগ্র এলাকাটিকে কয়েকটি সারি সারি প্রশস্ত প্লটে বিভক্ত করা হয় এবং প্রতি প্লট বিঘা প্রতি বার্ষিক ছয় টাকা হারে লিজ বা ইজারা দেওয়া হয়। অবিলম্বেই ওয়ারী একটি মর্যাদা সম্পন্ন উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির এলাকায় পরিণত হয়। এক ফরাসিদের আবাসস্থল ফরাসগঞ্জে গড়ে ওঠে চুন ও কাঠের ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে। এমনিভাবে নবাবগঞ্জ চর, পাট ব্যবসা এবং হাজারীবাগ একসময় যেটি ছিল একটি চমৎকার বাগান যা চামড়া ব্যবসার কেন্দ্রে পরিণত হয়।

১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর ঢাকা নতুন প্রদেশ পূর্ববঙ্গ ও আসামের রাজধানী হওয়ার মধ্যদিয়ে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়। একটি নতুন প্রদেশের রাজধানী হিসেবে অভ্যুদয়ের ফলে ঢাকাকে একটি রাজধানী শহর হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াসে সরকারি উদ্যোগে নানাবিধ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড শুরু হয়। শহরের উত্তর প্রান্তের রমনা এলাকায় বিভিন্ন সরকারি অফিস ও কর্মকর্তাদের বাসস্থান নির্মাণের জন্য বিরাট এক অঞ্চল অধিগ্রহণ করা হয়। খুব শিগগিরই রমনা এলাকায় এই সমস্ত বিশাল আকারের অট্টালিকা নির্মাণ ঢাকার জীবনে নিয়ে আসে এক নতুন চাকচিক্য।

৪৭ এর পর পাকিস্তান আমলে শহর কাঠামো পুরোপুরি বদলে যায়। তেজগাঁও, পোস্তাগোলা, হাজারীবাগ ইত্যাদি এলাকায় প্রচুর শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। চকবাজার, মিটফোর্ড ও ফরাশগঞ্জ এলাকা পরিণত হয় পাইকারি বাজার কেন্দ্রে। খুচরা ব্যবসা কেন্দ্র ইসলামপুর, পাটুয়াটুলী, বাংলাবাজার, নওয়াবপুর থেকে জিন্নাহ এভিনিউ (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ) পর্যন্ত ব্যাপ্ত হয়। জিন্নাহ এভিনিউ সেই সময়ে শহরের বাণিজ্য প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে।

সরকার পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা গড়ে তোলে ধানমণ্ডিতে। ১৯৫৯ সালে ঢাকার জন্য প্রথম মাস্টারপ্লান প্রণীত হয়। এই প্লান বাস্তবায়নের জন্য গঠিত হয় ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি, বর্তমানে রাজউক), ১৯৫৯ সালেই ইসলামাবাদকে পাকিস্তানের নতুন রাজধানী ঘোষণার সাথে সাথে ঢাকাতে দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এজন্য পৃথিবীর প্রথম সারির স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ফ্রান্সের লি কধুসিয়ের, ফিনল্যান্ডের অধ্যাপক আলভার আলটু এবং আমেরিকার লুই আই কানের মধ্যে শেষ জনকে নির্বাচিত করা হয় এবং দায়িত্ব দেওয়া হয় নতুন প্রশাসনিক শহর ডিজাইনের। লুই কানের করা বর্তমানের শেরে বাংলা নগরের মূল কাঠামোতে ছিল জাতীয় পরিষদ ভবন, প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবৃন্দ, ডেপুটি স্পীকার, সেক্রেটারি, জয়েন্ট সেক্রেটারিদের আবাসিক ভবন, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ও হাসপাতাল ইত্যাদি।

১৯৭১ সালে ঢাকা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে। ফলে নগরীর গুরুত্ব ও কর্মপরিধি বহুগুণ বেড়ে যায়। ঢাকাই হয়ে পড়ে বাংলাদেশের প্রশাসনিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক রাজধানী। এর দরুন বিপুলতর অভিবাসন ঘটে শহর অভিমুখে। সাথে সাথে ঢাকার আয়তন বাড়তে থাকে।

সত্তর দশকের শেষাংশ হতেই ঢাকা আনুভূমিকভাবে বাড়তে থাকে। নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গী ইত্যাদির মাঝে যে ছোটখাট শহর ছিল তা কনাবেশন প্রক্রিয়ায় মূল শহরের অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে। কুর্মিটোলায় নতুন বিমানবন্দর স্থাপন ও উত্তর মডেল টাউন নির্মাণের ফলে উত্তর-পশ্চিমে ঢাকা নগরী প্রসারিত হতে শুরু করে যা অদ্যাবধি অব্যাহত রয়েছে।

কালের পরিক্রমায় আজকের ঢাকা বাড়ছে শুধু বাড়ছেই, বারবার হচ্ছে তার মানচিত্রের পালাবদল। স্বাধীন স্বদেশে ঢাকা আমাদের বিস্ময়, স্বপ্ন, ভালোলাগা আর ভালোবাসা। ঢাকাকে আমরা এমন উচ্চতায় নিয়ে যাব; তখন নেপালি ছেলেটা গিটার হাতে বাজাবে এই ঢাকাতে।

অনুমতি ব্যতিত এই সাইটের কোনো কিছু কপি করা কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয়।

প্রিয় পাঠক অনলাইন নিউজ পোর্টাল দ্যামেইলবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন themailbdjobs@gmail.com ঠিকানায়।

More articles

সর্বশেষ

x  Powerful Protection for WordPress, from Shield Security
This Site Is Protected By
Shield Security