...
রবিবার, মার্চ ৩১, ২০২৪

নিরাপদ অভিবাসন টেকসই উন্নয়নে সহায়ক -মুহম্মদ ফয়সুল আলম

যা যা মিস করেছেন

মানবসম্পদ বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ। এই সম্পদের সঠিক যত্ন ও পরিচর্যার মাধ্যমে দেশ হয়ে উঠেছে সমৃদ্ধ ও সম্পদশালী। দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি এবং বিদেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল হচ্ছে। বিশ্বায়ন, যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন, উন্নত জীবন-জীবিকার আকাঙ্ক্ষার প্রেক্ষিতে অভিবাস বর্তমান বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ আলোচিত বিষয়। দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে প্রবাসী কর্মীদের প্রেরিত রেমিটেন্স এর অবদান জিডিপির ১৫ শতাংশের সমান। অভিবাসীদের মর্যাদা ও অধিকার সমুন্নত রাখার প্রয়াসে প্রতিবছর ১৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস পালিত হয়ে আসছে। ২০০০ সালের ৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর থেকে প্রতিবছর এই দিনে জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত সব দেশে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ‘দক্ষ হয়ে বিদেশ গেলে, অর্থ সম্মান দুই-ই মেলে এই প্রতিপাদ্যে বাংলাদেশেও এবছর নানা আয়োজনে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।

            টেকসই উন্নয়ন ২০৩০ এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অভিবাসন খাত বিশেষ করে শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, অসমতা হ্রাস সরাসরি জড়িত। বিশ্ব অভিবাসন রিপোর্ট ২০১৯ অনুযায়ী বর্তমান বিশ্বে অভিবাসী প্রায় ২৭ কোটি ২০ লাখ। এর মধ্যে বর্তমান বিশ্বের ১৭৩টি দেশে বাংলাদেশের ১ কোটি ২০ লাখের কিছু বেশি মানুষ অভিবাসী হিসেবে কর্মরত আছেন। বিশ্বে সর্বোচ্চ রেমিটেন্স অর্জনে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সর্বোচ্চ রেকর্ড পরিমাণ ১৬.৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিটেন্স পাওয়া গেছে যা পূর্বের ২০১৭-১৮ অর্থবছরের তুলনায় ৯.৬১% বেশি। সুতরাং নিঃসন্দেহে অভিবাসন বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

            প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অব্যাহত প্রচেষ্টায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬,৫৯,০৪৩ জন কর্মী বৈদেশিক কর্মসংস্থানে নিয়োজিত হয়েছেন। তন্মধ্যে পুরুষ কর্মীর সংখ্যা ৫,৫১,৪৭৮ জন এবং মহিলা কর্মীর সংখ্যা ১,০৭৫৬৫ জন।

            বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে যেসব খাত বিশেষ ভূমিকা রাখে তার মধ্যে ‘বৈদেশিক কর্মসংস্থান’ খাতটি অন্যতম। বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হওয়ায় একদিকে বেকারত্বের সংখ্যা কমছে এবং অন্যদিকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ‘রূপকল্প-২০২১’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রণায় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থাগুলো কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে, যাতে করে বিদেশে কর্মসংস্থান ও রেমিট্যান্সের মাধ্যমে ঘোষিত ‘রূপকল্প-২০২১’ বাস্তবায়নে সঠিক ভূমিকা পালন ও কার্যকর করতে পারে।

            বাংলাদেশ সরকার এদেশের শ্রমশক্তি বা জনবল যাতে দক্ষ হয়ে গড়ে ওঠে সেজন্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এ পর্যন্ত ৭০টি কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৫৫টি ট্রেডে মোট ৮ লাখ ৩৯ হাজার ৭২৭ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে। ২১টি টিটিসিতে জাপানিজ, কোরিয়ান, আরবি ও ইংরেজি ভাষা প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করা হয়েছে।

            ২০১৭ সালের স্বাক্ষরিত এমওইউ এবং ২০১৮ সালে জাপান সরকারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত এমওসি অনুযায়ী জাপানে বিনা অভিবাসন ব্যয়ে টেকনিক্যাল ইন্টার্ন প্রেরণ করা হচ্ছে। বিদেশ গমনেচ্ছু গমনকারী কর্মীদের সঠিকপন্থায় বিদেশ গমন এবং গন্তব্য দেশের আবহাওয়া, কর্মপরিবেশ, স্বাস্থ্যবিধি, আইনকানুন/বিধিবিধান, করণীয় বা বর্জনীয়, বৈধপথে রেমিট্যান্স প্রেরণ, উপার্জিত অর্থের সঠিক বিনিয়োগ ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা প্রদানের জন্য ৬০টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র(টিটিসি) ও ৬টি ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি (আইএমটিতে) তে প্রি-ডিপার্চার ট্রেনিং দেশব্যাপী পরিচালনা করা হয়েছে।

            মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনার ফলে মালয়েশিয়া, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশের বন্ধ শ্রম বাজার বাংলাদেশিদের জন্য উন্মুক্ত হয়েছে। ফলে কর্মসংস্থানের হার বেড়েছে এবং একইসাথে বাংলাদেশের অর্থনীতি বলিষ্ঠ ও বেগবান হচ্ছে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যেখানে বিশ্বের মাত্র ৯৭টি দেশে কর্মী প্রেরণ করা হতো, সেখানে নতুন আরও ৭৫টি দেশে কর্মী প্রেরণসহ বর্তমানে এ সংখ্যা ১৭৩টি দেশে ‍উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছে বর্তমান সরকার।

            প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বৈধপথে তথা ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণে প্রবাসী কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে বিদেশে অবস্থিত শ্রম উইংগুলোর মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এছাড়া বিদেশগামী কর্মীদের বিদেশ গমনের আগেই দেশে ব্যাংক অ্যাকউন্ট খোলা বাধ্যতামূলক করণ পূর্বক তাদের প্রি ডিপার্চার ট্রেনিংয়ে এ বিষয়ে ব্রিফিং দেওয়া হয়। অভিবাসনে পিছিয়ে থাকা ৪২টি জেলা চিহ্নিতকরণপূর্বক এসব জেলাকে অগ্রাধিকার দিয়ে বৈদেশিক কর্মসংস্থান বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বৈধপথে রেমিটেন্স করলে সরকার ২% হারে প্রণোদনা প্রদান করছে।

            বর্তমান সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে সৌদি আরবে প্রায় ৮ লাখ, মালয়েশিয়ার ২ লাখ ৬৭ হাজার এবং ইরাকে ১০ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীর বৈধতা প্রদানের মাধ্যমে অনিশ্চয়তা দূর করা হয়েছে।

            ঢাকাসহ ৩৬টি জেলায় বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের সেবা সহজীকরণের লক্ষ্যে ফিঙ্গারপ্রিন্ট কার্যক্রম বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে। ফলে ওই ৩৬টি জেলার কর্মীদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট কার্যক্রমের জন্য ঢাকায় আসতে হয় না। বিদেশে কর্মসংস্থানের ফলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বেকারত্বের হার কমেছে। দরিদ্রশ্রেণির আয় বেড়েছে। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণসহ তাদের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে এবং নানামুখি অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সম্প্রসারণ ঘটছে।

            সরকার প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ইনস্টিটিউটে জনসাধারণের কাজের দক্ষতা বৃদ্ধি, নারী কর্মীদের হাউজকিপিং কোর্সে প্রশিক্ষণ, মেরিন টেকনোলোজিতেও জনসাধারণকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দিয়ে ও তাদের প্রাক-বহির্গমন প্রশিক্ষণ প্রদান করে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করার যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

            বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিকতা ও উদ্যোগের ফলে একদিকে বিভিন্ন দেশে নতুন নতুন শ্রমবাজারের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে এবং অন্যদিকে শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ আগের তুলনায় অনেক নিরাপদ হচ্ছে। বাংলাদেশে অভিবাসনের বিষয়টি জাতীয় সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বাংলাদেশ নিরাপদ ও আইনানুগ অভিবাসনের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করায় সবসময় বেআইনি অভিবাসনকে নিরুৎসাহিত করে এবং মানবপাচার বিরোধী আইনের আওতায় এটিকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করে।

            বিদেশে কর্মরত নারীকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও অভিযোগ দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিএমইটিতে একটি সেল গঠন করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় ও দপ্তর/সংস্থায় অনলাইনে অভিযোগ ব্যবস্থাপনা চালু করা হয়েছে। তাছাড়া প্রবাসবন্ধু কল সেন্টার (+৮৮০১৭৮৪৩৩৩৩৩৩, +৮৮০১৭৯৪৩৩৩৩৩৩, + ৮৮০২-৯৩৩৪৮৮৮) স্থাপনের মাধ্যমে বিদেশগামী ও প্রবাসী কর্মীরা তাদের অভিযোগ/সহযোগিতার বার্তা জানাতে পারছেন।

            সরকার অভিবাসীদের ও তাদের পরিবারের সদস্যদের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিচ্ছে। অভিবাসন খরচ কমানো ও নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ডিজিটাইজড নিয়োগ পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। অভিবাসীদের উৎসাহিত করার জন্য তাদের সন্তানদের ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে স্নাতক শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। ২০০৯ সাল থেকে অদ্যাবধি ১৭টি দেশে ১৮টি নতুন শ্রম কল্যাণ উইং খোলা হয়েছে। বর্তমানে শ্রম কল্যাণ উইংয়ের সংখ্যা ৩০টি। ওয়েজ অর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে প্রবাসী কর্মীর মেধাবী সন্তানদের লেখাপড়ায় উৎসাহ জোগাতে ২০১২ সাল থেকে সম্পূর্ণ ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বৈদেশিক অভিবাসন এবং রেমিট্যান্স যথাযথ ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

            প্রবাসে কেউ মারা গেলে তার মৃতদেহ দেশে আনা, বিমানবন্দর থেকে মৃতদেহ পরিবারের নিকট হস্তান্তরের সময় তাৎক্ষণিকভাবে ৩৫ হাজার টাকা এবং বৈধভাবে কর্মরত বিদেশে মৃত কর্মীর পরিবারকে মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ বাবদ ৩ লক্ষ টাকা প্রদান করা হয়।

            অভিবাসন একদিকে যেমন পারিবারিক সমৃদ্ধি বয়ে আনে, তেমনি জাতীয় আয় বাড়াতে সাহায্য করে। বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হলো অভিবাস থেকে অর্জিত আয়। সুতরাং অভিবাসন প্রক্রিয়ায় সামগ্রিক সুফল পেতে হলে এ প্রক্রিয়াটিকে স্বচ্ছ ও নিরাপদ করার গুরুত্ব অপরিসীম। সরকারের সদিচ্ছা ও শুভ উদ্যোগ সফল হোক আন্তর্জাতিক অভিবাসন দিবসে এ আমাদের প্রত্যাশা।

অনুমতি ব্যতিত এই সাইটের কোনো কিছু কপি করা কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয়।

প্রিয় পাঠক অনলাইন নিউজ পোর্টাল দ্যামেইলবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন themailbdjobs@gmail.com ঠিকানায়।

More articles

সর্বশেষ

x  Powerful Protection for WordPress, from Shield Security
This Site Is Protected By
Shield Security
Seraphinite AcceleratorOptimized by Seraphinite Accelerator
Turns on site high speed to be attractive for people and search engines.