শনিবার, মে ৪, ২০২৪

১৯৭১সালে ডালিম হোটেল সত্যিকার অর্থেই ‘ডেথ-ফ্যাক্টরি’ ছিল

যা যা মিস করেছেন

মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামের আলবদর প্রধান মীর কাসেমের নেতৃত্বে আন্দরকিল্লার ‘মহামায়া ভবন’ দখল করে তার নাম পাল্টে ‘ডালিম হোটেল’ রাখা হয়। তার নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধা, তাদের সহযোগী ও হিন্দুদের ধরে সেখানে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হত।

আসামিপক্ষের দাখিল করা ‘প্রামাণ্য দলিল: মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ বইয়ের তথ্য উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, “আলবদর সদস্য ও পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে ডালিম হোটেলে নিয়ে আসত আমৃত্যু নির্যাতন করার উদ্দেশ্যেই।

“এটাও প্রমাণিত যে, ডালিম হোটেলে আলবদরের সদস্যদের পরিচালনা এবং নির্দেশনা দিতেন মীর কাসেম আলী নিজেই। ডালিম হোটেল সত্যিকার অর্থেই ‘ডেথ-ফ্যাক্টরি’ ছিল।”

সেখানে মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ মানুষকে ধরে এনে হাত-পা ভেঙে দেওয়া হতো এবং বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করা হত বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মীর কাসেমের বিরুদ্ধে মামলায় নির্যাতিত অনেকের সাক্ষ্যে উঠেছে।

ডালিম হোটেলে নিয়ে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমসহ মোট আটজনকে হত্যার ঘটনায় ১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগে ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ডের রায় এসেছিল।

রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষের আপিল আংশিক মঞ্জুর করে তাকে ১২ নম্বর অভিযোগ থেকে খালাস দিলেও জসিম হত্যার ঘটনার ১১ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া সর্বোচ্চ সাজার রায় বহাল রাখে সুপ্রিম কোর্ট।

২০১৬ সালের ৮ মার্চ সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া ওই রায় কাসেম পুনর্বিবেচনার আবেদন করলেও ৩০ অগাস্ট তা খারিজ হয়ে যায়। সব বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ৩ সেপ্টেম্বর শনিবার রাতে এই যুদ্ধাপরাধীর দণ্ড কার্যকর করা হয়।

মীর কাসেম ও তার সহযোগীদের নির্যাতনের কথা বলতে গিয়ে ৪৩ বছর পরও ভয়ে শিউরে উঠেছেন মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও সৈয়দ মো. এমরানসহ অনেকে।

দুজনই বলেন, শহরের কোথাও কোনো মুক্তিযোদ্ধা গোপনে আশ্রয় নিয়েছেন বলে খবর পেলেই মীর কাসেমের নেতৃত্বে বদর বাহিনী পাকিস্তানি সৈন্যদের নিয়ে অভিযান চালিয়ে তাদের ধরে ডালিম হোটেলে নিয়ে আসত।

১৯৭১ সালের ২৩ নভেম্বর নগরের কদমতলী এলাকায় কারফিউ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর চৌধুরীকে আটক করে ডালিম হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ৩০ নভেম্বর ভোরে মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মো. এমরানকে গ্রেপ্তার করা হয় চান্দগাঁও এলাকায় নিজ বাড়ি থেকে। একইদিন আন্দরকিল্লায় গোপন আস্তানায় বদর বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক নাসির উদ্দিন চৌধুরী।

তারা জানান, মীর কাসেমের উপস্থিতিতেই বদর বাহিনীর সদস্যরা চোখ-মুখ-হাত-পা বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে পেটাত, লোহার চেয়ারে বসিয়ে ইলেকট্রিক শক দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ও তাদের অস্ত্রের বিষয়ে জানতে চাওয়া হত। নির্যাতনের পর বন্দিরা পানি খেতে চাইলে প্রস্রাব খেতে দেওয়া হত।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দিন ১৬ ডিসেম্বর ভোর পর্যন্ত তারা সেখানে বন্দি ছিলেন বলে জানিয়েছেন এখনও সেই নির্যাতনের চিহ্ন শরীরে বয়ে বেড়ানো এই মুক্তিযোদ্ধারা।

রায়ে বলা হয়, “এইখানে অবৈধভাবে ধরে এনে আটকে রাখা প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে তাদের ওপর অত্যন্ত অমানুষিক উপায়ে নিয়মিতভাবে চরম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হত। অভিযুক্ত মীর কাসেম আলী এই বর্বর ব্যবস্থাটিতে সম্পৃক্ত ছিলেন।”

একাত্তরে ডালিম হোটেলকে ‘জল্লাদখানা’ হিসেবে চিনত চট্টগ্রামের মানুষ। ডালিম হোটেল ছাড়াও নগরীর চাক্তাই চামড়ার গুদামের দোস্ত মোহাম্মদ বিল্ডিং, দেওয়ানহাটের দেওয়ান হোটেল ও পাঁচলাইশ এলাকার সালমা মঞ্জিলে বদর বাহিনীর ক্যাম্প ও নির্যাতন কেন্দ্র ছিল।

নগরীর গুডস হিলসহ আরও কয়েকটি জায়গায় রাজাকার, আল শামস বাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র থাকলেও একাত্তরে মূর্তিমান আতঙ্কের নাম ছিল পুরাতন টেলিগ্রাফ রোডের ডালিম হোটেলই।

রায়ে বলা হয়, “কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম, টুনটু সেন ও রঞ্জিত দাসকে হত্যাসহ এখানে (ডালিম হোটেলে) পরিচালিত সব ধরনের অপরাধেই তার (মীর কাসেম) প্রত্যক্ষ মদদ ও উৎসাহ ছিল। নিহত বন্দিদের লাশও খুঁজে পায়নি তাদের স্বজনরা।”

মীর কাসেমের নির্দেশেই মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেককেই অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে কর্ণফুলী নদীর চাক্তাই চামড়ার গুদাম এলাকায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

ট্রাইব্যুনালে দেওয়া সাক্ষ্যেও এ কথা বলেছিলেন এমরান, যে হত্যাকাণ্ডের জন্য মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে।

ডালিম হোটেলের অন্য কক্ষগুলোতে আরও চার-পাঁচজন বন্দিকে হত্যার পর কর্ণফুলী নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেওয়ার কথাও শুনেছিলেন বলে এমরান জানান।

রায়ে আরও বলা হয়, ডালিম হোটেলে ঘটে যাওয়া সব ধরনের অপরাধের ব্যাপারে সবকিছুই জানতেন মীর কাসেম। এসব অপরাধে তার ‘কর্তৃত্বপূর্ণ’ অংশগ্রহণও প্রমাণিত। ফলে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৪ (২) ধারা অনুযায়ী ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষে’র দায়ে দোষী।

মীর কাসেমের তখনকার অবস্থান জানিয়ে নির্যাতিতরা বলেন, তিনি যখন ডালিম হোটেলে ঢুকতেন, তখন পাহারায় থাকা বদর সদস্যরা বলে উঠতেন ‘কাসেম সাব আ গ্যায়া, কমান্ডার সাব আ গ্যায়া’।

বন্দি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য না পেলে মীর কাসেমের নির্দেশে নির্যাতনের মাত্রা কয়েক গুণ বেড়ে যেত বলেও নির্যাতিতরা জানান।

ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুর দিকে মীর কাসেম ডালিম হোটেলে যাওয়া বন্ধ করে দেয় বলে বন্দিদের সাক্ষ্য থেকে জানা যায়। ১৪ ডিসেম্বর বদর সদস্যরা ডালিম হোটেল ছেড়ে পালিয়ে যায়। ১৬ ডিসেম্বর ভোরে স্থানীয় লোকজন ও মুক্তিযোদ্ধারা ডালিম হোটেলের দরজা ভেঙে বন্দিদের উদ্ধার করে।

অনুমতি ব্যতিত এই সাইটের কোনো কিছু কপি করা কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয়।

প্রিয় পাঠক অনলাইন নিউজ পোর্টাল দ্যামেইলবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন themailbdjobs@gmail.com ঠিকানায়।

More articles

সর্বশেষ

x  Powerful Protection for WordPress, from Shield Security
This Site Is Protected By
Shield Security