
ফৌজদারি কার্যবিধির বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার (৫৪ ধারা) ও হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ধারা (১৬৭ ধারা) প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা দেওয়ার কথা জানিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল খারিজ করে দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত।
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ মঙ্গলবার এই রায় দেয়। এর ফলে ৫৪ ধারা ও ১৬৭ ধারা নিয়ে হাই কোর্টের নির্দেশনা বহাল এবং তা মানায় সরকারের বাধ্যবাধকতা থাকছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
এর আগে গত ১৭ মে আপিলের ওপর রাষ্ট্র ও রিটকারী পক্ষের আইনজীবীদের শুনানি শেষ হয়।
উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালে ডিবি পুলিশ ঢাকার সিদ্ধেশরী এলাকা থেকে ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনির্ভাসিটির ছাত্র শামীম রেজা রুবেলকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করে। পরে পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় রুবেল মারা যায়। পুলিশ হেফাজতে রুবেলের মৃত্যুর ঘটনায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাষ্ট্র (ব্লাষ্ট) সহ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন রিট আবেদন দায়ের করে।
২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল বিচারপতি মো. হামিদুল হকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেফতার ও রিমান্ড সংক্রান্ত ১৬৭ ধারার বিধান ৬ মাসের মধ্যে সংশোধনে এক যুগান্তকারী রায় দেন। পাশাপাশি উক্ত ধারা সংশোধনের পূর্বে হাইকোর্টের কয়েক দফা নির্দেশনা মেনে চলার জন্য সরকারকে নির্দেশ দেয়া হয়।
হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৪ সালে আপিল দায়ের করে চার দলীয় জোট সরকার। তখন আপিল বিভাগ লিভ পিটিশন মঞ্জুর করলেও হাইকোর্টের নির্দেশনাসূমহ স্থগিত করেনি। কিন্তু দীর্ঘ ১৩ বছর ওই আপিল ঝুলে থাকার পর বর্তমান প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব গ্রহনের মাধ্যমে কয়েক দফা এটি শুনানিতে আসে।
প্রসঙ্গত, হাইকোর্টের যুগান্তকারী নির্দেশনায় বলা হয়েছিলো:
ক. আটকাদেশ (ডিটেনশন) দেয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে পারবে না।
খ. কাউকে গ্রেফতার করার সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে।
গ. গ্রেফতারের কারন একটি পৃথক নথিতে পুলিশকে লিখতে হবে।
ঘ. গ্রেফতারকৃতের শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকলে তার কারন লিখে তাকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে ডাক্তারি সনদ আনবে পুলিশ।
ঙ. গ্রেফতারের তিন ঘন্টার মধ্যে গ্রেফতারকৃতকে এর কারণ জানাতে হবে।
চ. বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেফতারকৃতর নিকটাত্মীয়কে এক ঘন্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহক মারফত বিষয়টি জানাতে হবে।
ছ. গ্রেফতারকৃতকে তার পছন্দসই আইনজীবি ও নিকটাত্মীয়র সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে।
জ. গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) প্রয়োজন হলে ম্যাজিষ্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের অভ্যন্তরে কাঁচ নির্মিত বিশেষ কক্ষে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তার আইনজীবি ও নিকটাত্মীয় থাকতে পারবেন।
ঝ. কারাগারে জিজ্ঞাসাবাদে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া না গেলে তদন্তকারী কর্মকর্তা ম্যাজিষ্ট্রেটের আদেশক্রমে সর্বোচ্চ তিন দিন পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে। তবে এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত কারণ থাকতে হবে।
ঞ. জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ওই ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে।
ট. পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিষ্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করবেন। বোর্ড যদি বলে ওই ব্যক্তির ওপর নির্যাতন করা হয়েছে তাহলে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ম্যাজিষ্ট্রেট ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং তাকে দণ্ডবিধির ৩৩০ ধারায় অভিযুক্ত করা হবে।
ঠ. পুলিশ হেফাজতে বা কারাগারে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ ম্যাজিষ্ট্রেটকে জানাতে হবে।
ড. পুলিশ বা কারা হেফাজতে কেউ মারা গেলে ম্যাজিষ্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে তা তদন্তের ব্যবস্থা করবেন। মৃত ব্যক্তির ময়না তদন্ত করা হবে। ময়না তদন্তে বা তদন্তে যদি মনে হয় ওই ব্যক্তি কারা বা পুলিশ হেফাজতে মারা গেছে তাহলে ম্যাজিষ্ট্রেট মৃত ব্যক্তির আত্মীয়ের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তা তদন্তের নির্দেশ দিবেন।