জীবনসঙ্গীনি হিসেবে নেপথ্যে থেকে শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব কিভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতি ও মুক্তি সংগ্রামে সহায়তা করেছেন তা স্মরণ করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আজ সোমবার (০৮ আগস্ট) ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব’-এর ৮৬তম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে নানা স্মৃতি তুলে ধরেন বড় মেয়ে শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “জীবনে যত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, তা আমার বাবা (বঙ্গবন্ধু) করেছেন। প্রতিটি কাজ যে তিনি করেছেন, আমার মা কিন্তু ছায়ার মত তাকে সাহায্য করে গেছেন। কখনও অভিযোগ-অনুযোগ তিনি করেননি।
“যত কষ্টই হোক, বাবাকে কখনই বলেননি যে, তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও বা সংসার কর বা সংসারের খরচ দাও। কোনোদিন জীবনের কোনো প্রয়োজনে বাবাকে কখনও বিরক্ত করেননি। বরং আব্বা যে পদক্ষেপ নিতেন সেটাকেই সমর্থন করতেন তিনি।”
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল সেনা সদস্যের হাতে বঙ্গবন্ধু ও তিন ছেলের সঙ্গে নিহত হন ফজিলাতুন নেছা মুজিব। দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সে সময় বিদেশে থাকায় রক্ষা পান।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
ছাত্র বয়স থেকে আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বারবার কারাবরণ করতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। তখন সংসার, মামলা ও সংগঠন চালানোয় ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ভূমিকার কথা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্বের কারণে ‘কখনই বাবাকে এক নাগাড়ে দুই বছর কারাগারের বাইরে’ থাকতে দেখেননি বলে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।
বঙ্গবন্ধুর জেলে থাকা অবস্থায় ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সংগঠন চালানোর কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন বলেন, “বিশেষ করে ছাত্রলীগকে তিনি নিজের হাতেই গড়ে তুলতেন। ছাত্রলীগকে সবসময় পরামর্শ দেওয়া, তাদের যা কিছু দরকার, তিনিই দেখতেন।
সংগঠন চালানোর প্রয়োজনে গহনা থেকে শুরু করে ঘরের ফ্রিজ পর্যন্তও ফজিলাতুন নেছা বিক্রি করেছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
“একটার পর একটা ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে, কিন্তু আমার মাকে কখনই আমি ভেঙে পড়তে দেখিনি। একটা মানুষের চরিত্র কতটা দৃঢ় থাকলে যেকোনো অবস্থা মোকাবেলা করার মত ক্ষমতা ধারণ করতে পারে..। হা-হুতাশ করার কথা কখনও আমার ময়ের মুখে আমি শুনিনি।”
ছয় দফা দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে প্রথমে কারাগারে ও পরে সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয় উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “পাঁচ মাস আমরা জানতেও পারিনি তিনি বেঁচে আছেন কি না।
“সেই সময় আন্দোলন গড়ে তোলা.. আমার মা আমাদেরকে নিয়ে ছোট ফুপুর বাসায় যেতেন। ওখানে গিয়ে নিজে পায়ের স্যান্ডেল বদলাতেন, কাপড় বদলাতেন, বোরকা পড়তেন, একটা স্কুটারে করে আমার মামাকে নিয়ে ছাত্র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক, আন্দোলন চালাবে কীভাবে তার পরামর্শ দেওয়া, নির্দেশ দেওয়া- তিনি নিজে দিতেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা।
“আন্দোলন সফল করার জন্য তিনি কাজ করতেন। কিন্তু কখনই পত্রিকায় ছবি ওঠা- এসব দিকে তিনি ছিলেন না।”
একটা সময় ছয় দফা না আট দফা হবে তা নিয়ে মতবিরোধে অনেক আওয়ামী লীগ নেতাও আট দফার পক্ষে চলে গিয়েছিলেন বলে জানান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।
“ছয় দফা থেকে একচুল এদিক ওদিক যাবে না, এইটেই ছিল তার সিদ্ধান্ত- এটা আব্বা বলে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের নেতারা উঠে পড়ে লাগলেন। আট দফা খুবই ভাল, আট দফা মানতে হবে।
তখন তার মায়ের ছয় দফার পক্ষে অবস্থানের কথা উল্লেখ কেরে শেখ হাসিনা বলেন, “মা বলেছিলেন, শুধু এটকুই বুঝি ছয় দফাই হচ্ছে বাংলার মানুষের মুক্তির সনদ, এটা উনি (বঙ্গবন্ধু) বলে গেছেন, এইটেই মানি, এর বাইরে কিছু মানি না।”
রাজনৈতিকভাবে তিনি যে কত ‘সচেতন’ ছিলেন সেটা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এখানেও আমার মায়ের সেই দৃঢ়তা।”
আবার বঙ্গবন্ধু জেলে থাকার সময় সেখান থেকে দলের জন্য কিভাবে নির্দেশ নিয়ে আসতেন সে স্মৃতিচারণও করেন প্রধানমন্ত্রী।
“মায়ের স্মরণশক্তি ছিল অসাধারণ। আমরা মাঝে মাঝে বলতাম তুমি তো টেপ রেকর্ডার। আমাদের শিখিয়ে নিয়ে যেতেন কারাগারে গিয়ে কি করতে হবে। একটু হৈ চৈ করা, এর মাঝে বাইরের সমস্ত রিপোর্ট আব্বাকে দেওয়া এবং আব্বার নির্দেশটা নিয়ে আসা। এরপর সেটা ছাত্রদের জানানো। শ্লোগান থেকে শুরু করে বলতে গেলে সবকিছুই কিন্তু তিনিই (বঙ্গবন্ধু) কারাগার থেকে নির্দেশ দিয়ে দিতেন। সেভাবেই কিন্তু মা ছাত্রলীগকে কাজে লাগাতেন।”
শেখ হাসিনা বলেন, দেশ স্বাধীন হবে এ বিষয়ে তার মা আগে থেকেই অবগত ছিলেন।
“আব্বা যখন মন্ত্রী, এমপি, এমএলএ ছিলেন, করাচিতে যেতেন, আমার মা কিন্তু জীবনে একদিনও করাচিতে যাননি। কোনোদিন যেতে চাননি। কারণ উনি জানতেন, একমাত্র উনিই বোধহয় সবথেকে বেশি আগে জানতেন যে, দেশ স্বাধীন হবে।
“এই যে স্বাধীনতার চেতনায় নিজেকে উদ্বুদ্ধ করা, এটা আমার মায়ের ভেতর তীব্র ছিল এবং একটা বিশ্বাসও ছিল।”
আবার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব করা হলে আওয়ামী লীগের নেতারা প্যারোলের পক্ষে বললেও ফজিলাতুন নেছা মুজিব তার বিরোধিতা করেছিলেন বলে জানান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।
“তার যে দূরর্দর্শিতা, রাজনীতিতে সেটাই কিন্তু আমাদের স্বাধীনতার পথ খুলে দিয়েছে। কারণ সেদিন যদি প্যারোলে যেতেন তাহলে বাংলাদেশ স্বাধীন হত না। এটা হল বাস্তবতা।”
রেসকোর্সে ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণেও মায়ের ভূমিকা রাখার কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
“কোনো কোনো নেতা বললেন এখনি বলে দিতে হবে আজ থেকে স্বাধীন। কেউ বললেন এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। কেউ কেউ এসে বলেছেন এটাই করতে হবে, না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। অমুক হবে, তমুক হবে। এরকম বস্তাকে বস্তা কাগজ আর পরামর্শ।
“মা বললেন (বঙ্গবন্ধুকে), সারাজীবন তুমি সংগ্রাম করেছ, জেল-জুলুম অত্যাচার সহ্য করেছ, তুমিই জানো এদেশের মানুষ কি চায়, যেটা তোমার থেকে বেশি কেউ জানে না। কাজেই তোমার মনে যে কথা আসবে তুমি সেই কথাই বলবে। কারও কথা তোমার শুনতে হবে না। ঠিক তাই এই সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। হাতে কোনো কাগজও ছিল না। কিছুই ছিল না।”
অনুষ্ঠনে শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জীবনের ওপর আলোচনা করেন লেখক সেলিনা হোসেন। বক্তব্য দেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি।