পেঁয়াজের পর এবার আলু নিয়ে একটি সিন্ডিকেট কারসাজি করে দাম বাড়াচ্ছে। দেশীয় চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত আলু মজুত থাকলেও রীতিমতো লাগামহীনভাবে বাড়ছে প্রতিদিনের রান্নায় অপরিহার্য এই পণ্যটির দাম। সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে গতকাল বুধবার এক দিনের ব্যবধানে মানভেদে প্রতি কেজি আলুর দাম বেড়েছে ১০ টাকা।
খুচরার পাশাপাশি পাইকারি বাজারেও বাড়তি দামে বিকোচ্ছে আলু। যদিও হঠাৎই এই দাম বাড়ার দৃশ্যমান ও গ্রহণযোগ্য কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে ক্রেতারা বলছেন, আলুর দাম বাড়ার নেপথ্যে কাজ করছে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট। আর ক্রেতাদের এই দাবিকে সমর্থন করছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যও। সরকারি এই প্রতিষ্ঠানাটির হিসাবে দেশে বর্তমানে চাহিদার অতিরিক্ত আলুর মজুদ রয়েছে। এছাড়া ক্রেতা সংকটের কারণে অনেক কৃষক ও হিমাগার মালিকও মজুদ আলু বিক্রি করা নিয়ে বিপাকে রয়েছেন। অতিরিক্ত মজুদের পরেও কেন আলুর বাড়তি দাম তার সঠিক উত্তর নেই সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছেও।
এদিকে ব্যবসায়ীদের কারসাজি ও বন্যার প্রভাবে আলুর পাশাপাশি পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ ও চালের মতো নিত্যপণ্যসহ সব ধরনের শাক-সবজির দামও চড়েছে। অথচ কাঁচামরিচ ছাড়া এগুলোর কোনোটিরই মজুদে ঘাটতি নেই। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতিতে নিম্ন আয়ের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে। সে কারণে অনেকেই এখন প্রয়োজনের তুলনায় কম পরিমাণে বাজার করছেন। ভোক্তাদের দাবি, ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে প্রতিদিনই দাম বাড়াচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, এই কারসাজি বন্ধে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও। কেউ কেউ ভোক্তা অধিকার আইনের পরিবর্তনও চেয়েছেন। তবে ব্যবসায়ীদের দাবি, বন্যার কারণে সরবরাহ কমে যাওয়ায় তাদেরও বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে এ বছর সারা দেশে ৯২ লাখ ৫৪ হাজার টন আলু উৎপাদন হয়েছে। আর দেশে বছরে আলুর চাহিদা ৮০ লাখ টন। এ ছাড়া প্রায় ৫০ হাজার টন আলু রপ্তানি হয়ে থাকে। তাই প্রতি বছর অক্টোবর-নভেম্বরে কৃষকদের আলু নিয়ে বিপাকে পড়তে হয়। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কৃষক ও হিমাগার মালিকরা আলু নিয়ে বিপাকে আছেন। তারা ক্রেতা সংকটে ভুগছেন। অথচ বাজারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকা দরে। অথচ অন্যান্য বছর এই সময়ে প্রতি কেজি আলু ২০-২৫ টাকা দরে বিক্রি হয়। চাহিদার অতিরিক্ত মজুদের পরেও কেন আলুর এত দাম তার সঠিক উত্তর নেই সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে।
গত শুক্রবার থেকে রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে আলুর কোনো ঘাটতি নেই। মানও ভালো। তবুও দাম বাড়তি। কয়েকজন বিক্রেতার কাছে দাম বাড়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা বলেন, পাইকারিতে দাম বেশি। তারা কী করবেন? তবে ওইসব বিক্রেতাও আলুর এমন অস্বাভাবিক দাম নিয়ে বিস্মিত।
মহাখালী কাঁচা বাজারের আলু ব্যবসায়ী বলেন, ‘২০ বছর ঢাকায় আলু বেচি। কিন্তু কোনোদিন ৫০ টাকায় পুরনো আলুর দাম দেখিনি। কোল্ড স্টোরেজের মালিকরাও জানিয়েছেন, তাদের আলু বিক্রি করতে পারছেন না। তাহলে দাম এত বাড়তি কেন তা আমি নিজেই বুঝছি না। আপনাকে (এই প্রতিবেদক) কী বুঝাব! আমার কাছেও মনে হয় এর পেছনে কারসাজি আছে।’
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সহ-সভাপতি এবং আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক বলেন, ‘বাজার এখন অসাধু ব্যবসায়ীদের দখলে চলে গেছে। এটা সত্য কথা। নইলে আলুর কেজি কীভাবে ৫০-৬০ টাকা হয়! বাজারে তো আলুর কোনো ঘাটতি নেই। এরা কারা তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব প্রশাসনের। প্রয়োজনে আইনের পরিবর্তন করে অসাধু ব্যবসায়ীদের কঠিন শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’
প্রতি বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে কাঁচামরিচের দাম একটু বাড়তি থাকে। কিন্তু তা কখনই ১২০-১৩০ টাকার ওপরে ওঠে না। অথচ রাজধানীতে গতকাল প্রতি কেজি কাঁচামরিচ ২২০-২৪০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। বাজারে পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা দরে। চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে চাল। সরকার পাইকারি পর্যায়ে দাম নির্ধারণ করে দিলেও কোনো লাভ হয়নি। আর কাঁচাবাজারে ৫০ টাকার নিচে মিলছে না কোনো সবজি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, এবার দেশে ৪ দফায় বন্যা হয়েছে। এতে সবজি ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। কৃষকের ব্যাপক লোকসান হয়েছে। বন্যাপরবর্তী সময়ে সবজি লাগালেও বৃষ্টির কারণে আবারও তা নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া বর্তমান সময় গ্রীষ্মকালীন ফসলের শেষ ও শীতকালীন সময়ের শুরুর মধ্যবর্তী সময়। তাই দাম একটু বাড়তি থাকবে এটা স্বাভাবিক। তবে অতিরিক্ত দামের পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজিও আছে বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা। নভেম্বরে নতুন সবজি বাজারে এলে দাম কিছুটা কমবে বলে আশা করছেন তারা।
কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের সঠিক দাম পাচ্ছে কি-না তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে। বিষয়টি কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের দেখভাল করার কথা থাকলেও তারা লোকবল সংকটের কারণে পারছে না বলে দাবি করেছে।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘কৃষক এখন সবজিতে কিছুটা ন্যায্য দাম পাচ্ছে। তবে বর্তমানে আলু ও চালের যে বাড়তি দাম তাতে কৃষকের কোনো লাভ নেই। এটা একটি শ্রেণি কারসাজি করে বাড়িয়েছে। কিন্তু আমাদের বিধিমালায় অভিযানের ক্ষমতা না থাকায় কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছি না।’
এ ব্যাপারে মন্তব্য জানতে বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দীন ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাবলু কুমার সাহার মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। আর বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে থাকায় তার মতামত জানা সম্ভব হয়নি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘কিছু যৌক্তিক কারণে সবজির দাম বেড়েছে। তবে কিছু কারসাজিও আছে। বর্তমানে বাজারে যে ঊর্ধ্বগতি চলছে তাতে অর্থনীতিতে খুব বড় প্রভাব হয়তো পড়বে না। তবে সাময়িক সময়ের জন্য সাধারণ নাগরিকের সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধান জরুরি।’