একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর আপিলের রায় ঘোষণা হবে ৬ জানুয়ারি।
দুই পক্ষের শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ মঙ্গলবার রায়ের এই দিন ঠিক করে দেয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাবনায় হত্যা, ধর্ষণ এবং বুদ্ধিজীবী গণহত্যার দায়ে গতবছর ২৯ অক্টোবর নিজামীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
রায়ে বলা হয়, শত শত নিরস্ত্র মানুষ, অসংখ্য বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী হত্যার সঙ্গে সম্পর্কিত এই চার অপরাধ ছিল একাত্তরের বড় ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা। বুদ্ধিজীবী হত্যা ও নিরস্ত্র মানুষকে গণহত্যা ছিল ‘ভয়ানক’।
এই চার অভিযোগ ছাড়াও অপহরণ, হত্যার চার ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় নিজামীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত। প্রসিকিউশনের আনা ১৬ অভিযোগের মধ্যে বাকি আটটিতে খালাস পান তিনি।
জামায়াতে ইসলামীর আমির নিজামী একাত্তরে ছিলেন দলটির ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নাজিমে আলা বা সভাপতি এবং সেই সূত্রে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য গঠিত আল বদর বাহিনীর প্রধান।
স্বাধীনতাকামী বাঙলির ওপর দমন-পীড়ন চালাতে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য গঠিত রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটিতেও তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে উঠে আসে।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে গত ২৩ নভেম্বর সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করেন নিজামী। ছয় হাজার ২৫২ পৃষ্ঠার নথিপত্রসহ নিজামীর করা আপিলে ১৬৮টি যুক্তি তুলে ধরে সাজার আদেশ বাতিল করে খালাস চাওয়া হয়। সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়ায় রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেনি রাষ্ট্রপক্ষ।
এই আপিলের ওপর চলতি বছরের ৯ সেপ্টেম্বর শুনানি শুরু হয়। মঙ্গলবার দশম দিনের শুনানির শুরুতে নিজামীর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি খণ্ডন করেন। পরে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুব আলম তার জবাব দেন।
ট্রাইব্যুনালের রায়
২০১০ সালের ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের একটি মামলায় মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেপ্তার করার পর একই বছরের ২ অগাস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
এরপর ২০১৩ সালের ২৮ মে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে জামায়াত আমিরের যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়।
তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক খানসহ প্রসিকিউশনের পক্ষে মোট ২৬ জন এ মামলায় সাক্ষ্য দেন। নিজামীর পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেন তার ছেলে মো. নাজিবুর রহমানসহ মোট চারজন।
বিচার শেষে গতবছর ২৯ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল যে রায় দেয় তাতে প্রসিকিউশনের আনা ১৬ অভিযোগের মধ্যে আটটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়।
এই আট অভিযোগের মধ্যে ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর ঘটনায় নিজামীর ফাঁসির রায় হয়।
এসব ঘটনার মধ্যে সাঁথিয়ার বাউশগাড়ি, ডেমরা ও রূপসী গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে হত্যা, ৩০-৪০ জন নারীকে ধর্ষণ; করমজা গ্রামে নয়জনকে হত্যা, একজনকে ধর্ষণ, বাড়িঘরে লুটপাট-অগ্নিসংযোগ; ধুলাউড়ি গ্রামে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ ৫২ জনকে হত্যা এবং মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের ঊষালগ্নে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার অভিযোগ রয়েছে।
আর অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় ১, ৩, ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে জামায়াত আমিরকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
এসব ঘটনার মধ্যে পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কছিমুদ্দিনকে অপহরণ করে হত্যা; মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প খুলে মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও সহযোগিতা; পাবনার বৃশালিখা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফ সেলিমের বাবা সোহরাব আলীকে স্ত্রী-সন্তানদের সামনে হত্যা; ঢাকার নাখালপাড়ার পুরোনো এমপি হোস্টেলে আটক মুক্তিযোদ্ধা জহির উদ্দিন বিচ্ছু জালাল, বদি, রুমি (শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ছেলে), জুয়েল ও আজাদকে হত্যার পরামর্শ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
বাকি আট অভিযোগ প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে না পারায় এসব অভিযোগ থেকে নিজামীকে খালাস দেয় ট্রাইব্যুনাল।
রায়ে বলা হয়, “দশকের পর দশক ধরে শহীদ বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ও নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের স্বজন ও জাতির অব্যক্ত ব্যথার ক্ষেত্রে আইনের ভাষা নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে না। ন্যায় বিচার হচ্ছে সেটাই, যা অপরাধীকে তার কৃতকর্মের ফল শোধ করে দেয়।”