বুধবার, মে ২৯, ২০২৪

সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হতে পারেন কেউ কেউ

যা যা মিস করেছেন

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ‘সীমা অক্সিজেন প্লান্টে’ বিস্ফোরণের ঘটনায় আহতদের অনেকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন। কেউ হারিয়েছেন পা। কেউ চোখ। কারও ফেটে গেছে কানের পর্দা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১৬ জনের দিন কাটছে চরম অনিশ্চয়তায়। রোববার রাতে হাসপাতালে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭ জনে। অনেক পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটির মৃত্যু বা পঙ্গুত্বে দিশেহারা স্বজনরা। ওই ঘটনায় গঠিত জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটির সদস্যরা সোমবার ঘটনাস্থলে যায়নি। এদিন তারা প্রতিষ্ঠানটির কাগজপত্র যাচাই-বাছাই বা ‘পেপার ওয়ার্ক’ করেছেন।

এদিকে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে এক সভা শেষে গণমাধ্যমকর্মীরা বিস্ফোরণের বিষয়ে জানতে চাইলে প্লান্টের এক পরিচালক কোনো কথা না বলে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন। শিল্প-কারখানা সংক্রান্ত ওই সভায় তিনি জেলা প্রশাসকের তোপের মুখে পড়েন। সভায় বলা হয়, ১৭ বছরে সীতাকুণ্ডে শিল্পকারখানায় বিস্ফোরণে ২৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এভাবে একের পর এক বিস্ফোরণ ও মৃত্যুর ঘটনা কাম্য নয়। দুর্ঘটনা হ্রাস করতে শিল্পকারখানার জন্য একটি মহাপরিকল্পনা তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ শিল্পকারখানার তিন ক্যাটাগরিতে তালিকা তৈরির জন্য কল-কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসক এবিএম ফকরুজ্জামান এ নির্দেশনা দেন।

বিস্ফোরণের ঘটনায় গুরুতর আহত এক ব্যক্তি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। তার নাম প্রবেশ লাল শর্মা (৫৫)। রোববার রাত ১১টার দিকে মারা যান তিনি। তার বাড়ি সীতাকুণ্ড থানার ভাটিয়ারী এলাকায়। তিনি সীমা অক্সিজেন কারখানায় সিনিয়র অপারেটর হিসাবে কাজ করতেন। শনিবার বিকালে অক্সিজেন প্লান্টে বিস্ফোরণের পর প্রবেশ লালকে উদ্ধার করে চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সংকটাপন্ন হওয়ায় ওইদিনই তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়েছিল। বর্তমানে আইসিইউতে অপর একজনসহ ১৬ রোগী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সোমবার একজনকে চিকিৎসা শেষে ছেড়ে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

সোমবার চমেক হাসপাতালের আইসিইউ’র সামনে কথা হয় সীমা অক্সিজেন প্লান্টের কর্মচারী মাকসুদুল আলমের (৬০) পরিবারের সঙ্গে। মাকসুদ ওই কারখানায় ফিলিং অপারেটর ছিলেন। বিস্ফোরণে ডান পায়ে গুরুতর আঘাত পান তিনি। হাসপাতালে নেওয়ার পর দুইবার অপারেশন করে তার পা কেটে ফেলা হয়েছে। বর্তমানে তিনি আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। তার জ্ঞান ফিরলেও পরিবারের সদস্যরা এখনো শঙ্কিত। স্ত্রী ও তিন মেয়ের পরিবারে তিনিই ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।

মাকসুদুলের মেয়ের জামাই মো. জসিম উদ্দিন বলেন, আমার স্ত্রীসহ শ্বশুরের তিন মেয়ে রয়েছে। তিনি যা বেতন পেতেন তাই দিয়ে সংসার চলত। তিনি এখন পঙ্গু হয়ে গেলেন। দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে আমাদের।

চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান যুগান্তরকে বলেন, বিস্ফোরণে আহতদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা নিতে হবে। বর্তমানে সবার অবস্থা স্বাভাবিক থাকলেও যে কোনো সময় কারও কারও শারীরিক পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। এর মধ্যে কারও কানের পর্দা, কারও চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। আহতদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে।

তদন্ত কমিটির কার্যক্রম : তদন্ত কমিটির সদস্য ও সীতাকুণ্ড থানার ওসি তোফায়েল আহমদ যুগান্তরকে বলেন, আমরা রোববার ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। নানা বিষয় পর্যবেক্ষণ করেছি। মালিক পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। হাসপাতালে গিয়ে বিস্ফোরণের সময় ঘটনাস্থলে থাকা আহত শ্রমিকদের সঙ্গেও কথা বলছি। বিস্ফোরণের কারণ উদ্ঘাটন, দায় কার, কোনো ধরনের নিরাপত্তা ঘাটতি ছিল কিনা এসব খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কী কারণে এত বড় ঘটনা ও প্রাণহানি তা সুস্পষ্টভাবে জানতে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আজকে (সোমবার) আমরা পেপার ওয়ার্ক করেছি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সীমা অক্সিজেন প্লান্টে নানা অনিয়ম ছিল। প্লান্টের বয়লার রক্ষণাবেক্ষণ করা একটি রুটিন ওয়ার্ক। কিন্তু তারা এসব করেনি। কর্মরত শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটিতে সরকারি তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোর চরম গাফিলতি ছিল বলে প্রাথমিকভাবে তদন্ত কমিটির সদস্যরা মনে করছেন।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, কারখানা স্থাপনের আগে ফায়ার সার্ভিসের কাছ থেকে অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা অনুমোদন নিতে হয়। সে অনুযায়ী, কারখানায় থাকার কথা ফায়ার স্টেশন, অগ্নিনির্বাপণের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, ফায়ার হোজ রিল, পানির রিজার্ভার ও হোসপাইপ। সীমা প্লান্টে এর কিছুই ছিল না বলে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছে সংস্থাটি।

বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র চট্টগ্রামের সভাপতি তপন দত্ত যুগান্তরকে বলেন, চট্টগ্রামে অক্সিজেন প্লান্ট, রাসায়নিক কারখানা, জাহাজভাঙা শিল্প ও রি-রোলিং মিল দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। ১৭ বছরে সরকারি তথ্য অনুযায়ী সীতাকুণ্ডে ২৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। বেসরকারিভাবে এ সংখ্যা আরও বেশি।

দুর্ঘটনা হ্রাসে মহাপরিকল্পনা তৈরির উদ্যোগ জেলা প্রশাসনের : নিয়মনীতির বাইরে গিয়ে কেউ শিল্পকারখানা পরিচালনা করতে পারবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। তিনি শিল্পকারখানার মালিকদের নিয়ম মেনে পরিচালনা করার নির্দেশনা দেন। সোমবার বেলা ১২টার দিকে সার্কিট হাউজে চট্টগ্রাম জেলার ভারী ও মাঝারি শিল্পপ্রবণ এলাকায় দুর্ঘটনা হ্রাসকল্পে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য অনুষ্ঠিত জরুরি সভায় তিনি এসব কথা বলেন। সভায় সীমা অক্সিজেন প্লান্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন উদ্দিন জেলা প্রশাসকের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হন। পরে গণমাধ্যমকর্মীরা বক্তব্য নিতে গেলে তিনি এক রকম দৌড়ে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।

সীমা অক্সিজেন প্লান্টে বিস্ফোরণের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) রাকিব হাসানের সঞ্চালনায় সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ-৩ চট্টগ্রামের এসপি মোহাম্মদ সুলাইমান, সীতাকুণ্ড উপজেলা চেয়ারম্যান এসএম আল মামুন, জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী, জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুদীপ্ত সরকার, মহানগর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর আহমদ, সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. শাহাদাৎ হোসেন, সীতাকুণ্ড থানার অফিসার ইনচার্জ তোফায়েল আহমদ প্রমুখ।

জেলা প্রশাসক বলেন, বাস্তবায়নযোগ্য একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরির সিদ্ধান্ত হয়েছে। নতুন যে শিল্পকারখানাগুলো হবে তা শতভাগ কমপ্লায়েন্স হতে হবে। কমপ্লায়েন্স ছাড়া কোনো শিল্পকারখানা উৎপাদনে যেতে পারবে না। এছাড়া তিন ক্যাটাগরিতে তৈরি হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ শিল্পকারখানার তালিকা। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শিল্পকারখানাগুলোকে রাখা হচ্ছে রেড ক্যাটাগরিতে। আর মাঝারি ধরনের সব ঝুঁকিপূর্ণ শিল্পকারখানা রাখা হচ্ছে ‘অরেঞ্জ’ ক্যাটাগরিতে। সবচেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ শিল্পকারখানার তালিকা রাখা হচ্ছে ‘গ্রিন ক্যাটাগরিতে’। এরপর ক্রাশ প্রোগ্রাম করে অভিযান পরিচালনা করা হবে।

যুগান্তরের প্রতিবেদন। 

অনুমতি ব্যতিত এই সাইটের কোনো কিছু কপি করা কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয়।

প্রিয় পাঠক অনলাইন নিউজ পোর্টাল দ্যামেইলবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন themailbdjobs@gmail.com ঠিকানায়।

More articles

সর্বশেষ

x  Powerful Protection for WordPress, from Shield Security
This Site Is Protected By
Shield Security