ঢাকার কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় নিহত সেজাদ রউফ অর্ক প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক প্রধান আবদুর রউফের নাতি, তার বাবা তৌহিদ রউফও ছিলেন সেনাবাহিনীর ঠিকাদার।
মঙ্গলবার পুলিশের অভিযানে নিহত সেজাদ (২৪) যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টধারী বাংলাদেশি। তিনি ২০০৯ সালে বাংলাদেশে ফিরে এসে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন বলে পুলিশ জানায়।
গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলায় ঘরছাড়া তরুণ-যুবকদের জড়িত থাকার তথ্য প্রকাশের পর র্যাব সারাদেশে নিখোঁজদের যে তালিকা করে, তাতে সেজাদের নামও ছিল।
সেজাদের বাবা ঢাকার বসুন্ধরা এলাকার বাসিন্দা তৌহিদ রউফ জানান, গত ফেব্রুয়ারিতে নিখোঁজ হন তার ছেলে। এরপর তিনি ভাটরা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন।
এরপর মঙ্গলবার রাতে পুলিশ নিহতদের ছবি প্রকাশ করলে তা দেখে বুধবার ডিএমপি কার্যালয়ে যান তৌহিদ। এরপর তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে নিয়ে লাশ দেখানো হয়।
লাশ দেখে ছেলের সঙ্গে কিছুটা মিল পেলেও পুরোপুরি নিঃসন্দেহ ছিলেন না তৌহিদ। এরমধ্যেই পুলিশ জাতীয় পরিচয়পত্র এবং তার সঙ্গে নেওয়া আঙুলের ছাপ মিলিয়ে সাজাদকে শনাক্তের কথা জানায়।
সেজাদসহ নিহত নয়জনই জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা নিয়ে কল্যাণপুরের তাজ মঞ্জিলে জড়ো হয়েছিলেন বলে পুলিশের ভাষ্য।
সেজাদের দাদা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুর রউফ এক সময় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান ছিলেন।
তার দুজন সহকর্মীর সূত্রে জানা যায়, আবদুর রউফ ১৯৭৩ সালে ডিএফআই ( বর্তমানে ডিজিএফআই) পরিচালকের দায়িত্ব পান। মেয়াদ শেষের পর ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট তার দায়িত্ব হস্তান্তরের কথা ছিল ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিল আহমেদের কাছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় তা ঠেকাতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার জামিল। ব্রিগেডিয়ার রউফ অবসর নেওয়ার সময় জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থায় (এনএসআই) কর্মরত ছিলেন বলে তার তৎকালীন ওই দুই সহকর্মী জানান।
ব্যবসায়ী তৌহিদ রউফও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন ঠিকাদার ছিলেন। তিনি অস্ত্র সরবরাহও করতেন বলে কলকাতার দৈনিক টেলিগ্রাফ তাদের পারিবারিক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে।
ছেলে সেজাদের যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ছিল বলেও সাংবাদিকদের জানান তিনি। মর্গে তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের একজন কর্মকর্তাও গিয়েছিলেন।
ওয়াশিংটন পোস্ট জানায়, সেজাদ রউফের জন্ম বাংলাদেশেই। তবে ১৯৯৯ সালে তারা পরিবারের সবাই যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হন।
তৌহিদ রউফ ছাড়া তার পরিবারের সবাই ১৯৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর দেশটির নাগরিকত্ব নিয়ে শিকাগো থেকে সান ফ্রান্সিসকোতে গিয়ে বসবাস শুরু করেন।
ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়,সেজাদের কৈশোরের অনেকটা সময় কাটে ইলিনয় ও ক্যালিফোর্নিয়ায়। পরে তার মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে তাদের পরিবার ২০০৯ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসে।
সেজাদের স্বজন টেলিগ্রাফকে বলেন, “২০০৯ সালে মা মারা যাওয়ার পর সেজাদ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া শুরু করে। তবে সে যে জঙ্গি হয়ে উঠেছে, তা আমাদের ধারণাতেও ছিল না। কারণ পরিবারের কেউ এমন নয়। আমরা তার এই কর্মকাণ্ড সমর্থন করি না।”
গুলশানের ক্যাফেতে হামলার পর নতুন করে হামলার হুমকি দিয়ে আইএসের নামে যে ভিডিও ইন্টারনেটে এসেছিল, তাতে আরেক সেনা কর্মকর্তার ছেলে আরাফাত হোসেন তুষারকে দেখা যায়।
দন্ত চিকিৎসক তুষারের বাবা প্রয়াত মেজর ওয়াসিকুর রহমান বলে র্যাবের নিখোঁজ তালিকায় উল্লেখ করা হয়।তুষার মডেল নায়লা নাইমের সাবেক স্বামী।
বসুন্ধরায় সি ব্লকের ১০ নম্বর সড়কে সেজাদদের বাসায় বৃহস্পতিবার বিকালে গেলে নিরাপত্তাকর্মী হামিদুর রহমান জানান, বুধবার সকালে বেরিয়ে যাওয়ার পর আর ফেরেননি তৌহিদ রউফ।
ভাটারা থানার ওসি নুরুল মোত্তাকিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরাও গিয়েছিলাম ওই বাসায়। গতরাতে তিনি বাসায় ফেরেননি। ছেলের এই অবস্থায় হয়ত কোনো স্বজনের বাসায় আছেন।”
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরার পর ২০১০ সালে ঢাকার আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল থেকে পাস করে সেজাদ নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন।
গুলশানে হামলাকারীদের একজন নিবরাজ ইসলাম এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র ছিলেন এবং তিনি সেজাদের বন্ধু ছিলেন বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তারা। শাহবাগ থানার একটি মামলায়ও দুজনই আসামি ছিলেন।
সেজাদ নিখোঁজ হওয়ার তিন দিন আগে গত ৩ ফেব্রুয়ারি বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হন নিবরাজ। গত ১ জুলাই হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালিয়ে ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে হত্যার পর অভিযানে নিহত হন নিবরাজসহ ছয়জন।
কল্যাণপুরে সেজাদের সঙ্গে নিহত রায়হান কবির ওরফে তারেক গুলশানে হামলাকারীদের প্রশিক্ষক ছিলেন বলে পুলিশ জানিয়েছে।
গুলশানে হামলার পর আইএসের নামে দায় স্বীকার বার্তা ইন্টারনেটে এলেও সেই দাবি উড়িয়ে পুলিশ বলছে, এরা জেএমবির সদস্য। রায়হান জেএমবির ঢাকা অঞ্চলের সমন্বয়ক ছিলেন বলে জানান গোয়েন্দা কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম। সেজাদসহ নিহত অন্যরাও জেএমবির সদস্য বলে পুলিশ জানিয়েছে।