শুক্রবার, মে ৩, ২০২৪

শেকড়ে বিষ

যা যা মিস করেছেন

ডঃ রাহেনা বেগম (পিএইচ.ডি), কলাম লেখক, দ্যা মেইল বিডি ডট কম।

আজকের শিশু আগামির ভবিষৎ। একটা দেশের উন্নতি নির্ভর করে শিশু-কিশোরদের উপর। আজ কাল পত্র-পত্রিকা খুললেই আমরা নানান ধরনের সন্ত্রাসের খবর দেখতে পাই। কিছু কিছু সন্ত্রাসের চিত্র আমরা দেখতে পাই যার নায়ক হচ্ছে শিশু-কিশোররা।

psychology of baby the mail bd

যে বয়সে শিশুদের হাতে থাকার কথা বই, খেলনা, পবিত্র দুই চোখে জ্ঞানের পিপাসা সে বয়সে কেন এরা এই পথে? এ প্রশ্ন আপনার, আমার, সবার। কিন্তু এর উত্তর আমাদের জানা নেই। একজন শিশু-কিশোর নিশ্চয় সন্ত্রাসী হিসেবে জন্মগ্রহণ করে না। আসুন না, আমরা তলিয়ে দেখি একজন শিশু-কিশোরকে সন্ত্রাসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে কে বা কারা?

মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড-এর মতে, প্রাপ্ত বয়সে ব্যক্তিত্বের অপউপযোজনের মূলে রয়েছে শৈশবকালীন দুঃখজনক অভিজ্ঞতা। এরিকসনও মনে করেন যে, শৈশব হচ্ছে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে অঅত্মবিকাশের প্রেক্ষাপট, এখানে আমাদের বিশেষ বিশেষ দোষগুন ধীরে ধীরে অথচ সুষ্ঠভাবে বিকশিত হয়। এরিকসন-এর মতে, শিশুদের মধ্যে “মৌলিক বিশ্বাস” অথবা “মৌলিক অবিশ্বাস” এর ভিত্তি নির্ভর করে কিভাবে তাদের যত্ন করা হয় তার ওপর। অর্থাৎ শিশুদের যত্নের প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে পৃথিবীকে তারা একটি নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য ও তাদের ভালোবাসাপূর্ণ স্থান বলে বিশ্বাস করবে, নাকি একে ভীতিপ্রদ অনিশ্চিত এবং বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ বলে ভাবতে শিখবে।

এরিক বার্ণ-এর মতে প্রত্যেক শিশুই রাজপুত্র বা রাজকন্যা হিসাবে জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু তার বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়া তাকে ব্যাঙ এ পরিবর্তন করে। এরিক বার্ণ বলেছেন প্রত্যেক শিশুর জীবনে ৪টি Life position আছে। Life positions are psychological senses regarding self, others and life, which the person takes.

Life positions ৪ টি হচ্ছেঃ

  1. I’m Ok, You’re Ok-  প্রত্যেক শিশুই এই position এ জন্মগ্রহণ করে। এটি potentially healthy position. এই position এর ব্যক্তিরা সাধারণত বাস্তববাদি, যে কোন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে পারে এবং সামনে এগিয়ে যায়। এদের basic operation is “Get-On-With”.
  2. I’m Ok, You’re not Ok- এই position এর ব্যক্তিরা নিজেকে পরিস্থিতির শিকার বলে ভাবে। এই ধরণের ব্যক্তিদের অবদমিত অনুভূতি হল রাগ, তারা সবাইকে দোষ দেয় (Blamers)। এদের basic operation is “Get-Rid-of”.
  3. I’m  not Ok, You’re Ok- এই position এর ব্যক্তিরা যখন নিজেকে অন্যের সাথে তুলনা করে, তখন নিজেকে ছোট (Inferior) এবং ক্ষমতাহীন মনে করে। তারা লাজুক প্রকৃতির  হয়ে থাকে, নিজেকে সব কিছু থেকে গুটিয়ে রাখে, কখনও কখনও এরা নৈরাশ্যবাদী হয়ে থাকে। এই ধরণের ব্যক্তিদের অবদমিত অনুভূতি হল-দুঃখ। এদের basic operation is “Get-Away-From”.
  4. I’m not Ok, You’re not Ok-  এই position এর ব্যক্তিরা বেঁচে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, আশাহীন অবস্থা। এদের basic operation is “Get-Nowhere-With”.

baby the mail bd

একজন শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে তখন সে ভীষণ অসহায় থাকে। ধীরে ধীরে মা-বাবা, সেবাদানকারীর আশ্রয় তলে নিরাপদভাবে সে বেড়ে ওঠে। শিশু প্রথম শিক্ষা লাভ করে তার পরিবার থেকে।তাই এরিকসনের মত অনুযায়ী আমরা বলতে পারি, শিশুর মৌলিক বিশ্বাস অথবা মৌলিক অবিশ্বাস-এর বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছে শিশুর পরিবার থেকেই। শিশুরা অনুকরণ প্রিয়। পরিবারে বাবা-মা এবং অন্যদেরকে সে অনুসরণ ও অনুকরণ করতে থাকে। পরিবারে একজন শিশু যখন দেখে তার বাবা বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও টেলিফোনে কেউ যখন তার বাবাকে ডাকেন তখন তিনি শিশুকে বলতে বলেন যে, তিনি বাড়ি নেই। মা এদেশ থেকে কেনা কোন শাড়ি তার বান্ধবীকে বিদেশী বলে চালিয়ে দেন। তার চাচা অফিসের হিসাব ঠিক করতে না পেরে তাকে গোজামিল দিয়ে ঠিক করে, এ রকম পরিবারের অন্য সদস্যদের হাজারটা দোষ শিশু দেখতে থাকে।

যেহেতু শিশুর এই বয়সটা অনুকরণের এবং শিশুরা মডেল হিসেবে নেয় তার পরিবারের সদস্যদের, সেহেতু সে পরিবারের সদস্যদের অনুকরণ করে। শুরু হয় তার মিথ্যা বলা, চালাকি করা। সারারাত ধরে ডিশে কোন মজাদার কার্টুন দেখে, কাজেই স্কুলের পড়া তার তৈরি করা হয় না কিন্তু ওর তো কোনো অসুবিধা নেই। ও তো জানে, এসব ক্ষেত্রে মিথ্যা বললেই সব ঠিক। তাই ম্যাডাম পড়া জিজ্ঞাসা করলে বলে, ম্যাডাম, রাতে আমার দাদী ভীষণ অসুস্থ ছিল, ওনাকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে, তাই পড়া করে আসতে পারিনি। দেশি পেন্সিল বক্স বন্ধুকে দেখিয়ে বলে বিদেশ থেকে চাচা পাঠিয়েছে। অংকে ৭ পেয়ে সেটাকে ৭০ বলে চালিয়ে দেয় বাবা-মার কাছে। এ রকম ছোট ছোট অপরাধ-সন্ত্রাস করতে করতেই সে একদিন বড় অপরাধী-সন্ত্রাসী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

পরিবারের পরেই আসে বিদ্যালয়ের কথা, যেখান থেকে শিশু তার শিক্ষা অর্জন করে। একজন শিশুর বিকাশের ক্ষেত্র শিক্ষকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আমার জানা এক স্কুলের কথা বলি- যেখানে প্রথম শ্রেণীর একজন শিক্ষিকা ক্লাসে চাকু নিয়ে বসেন, শিশুদের শান্ত রাখার জন্য। তিনি শিশুদের বলেন যে- যে ক্লাসে চুপ করে থাকবেনা, তার পা কেটে শো-কেস এ রাখা হবে, বা স্কুলের ল্যাব এ দেয়া হবে এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য। ছোট ছোট শিশুদের স্কুলের এমন অভিজ্ঞতা তাকে কিভাবে বিকাশে সাহায্য করবে?

child phychology the mail bd

এরিক বার্ণ-এর মত অনুযায়ী প্রত্যেক শিশু তার Life Script তৈরী করে। এরিক বার্ণ এর মতে––“Script is a life plan made in early childhood, reinforced by the parents, justified by subsequent, and culminating in a chosen alternative”. এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে,একটা শিশু যে তার Life Script তৈরী করে তাতে তার পরিবার এবং পরিবেশের ভূমিকা কত ব্যাপক।
আমরা যদি শিশুদেরকে আগামী দিনের ভবিষৎ মনে করি তবে আমাদের সঠিক parenting & care taking process জানতে হবে এবং সেভাবেই আমাদের সন্তানদের গড়ে তুলতে হবে। পারিবারিক বন্ধন ও মূল্যবোধ দৃঢ় করতে হবে।

লেখাটা শেষ করার আগে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের একটা বিখ্যাত গল্প বলার লোভ সামলাতে পারছিনা। এক গায়ে এক ছেলে বাস করতো তার পিসির (ফুফু) সঙ্গে। একদিন সেই ছেলেটি স্কুল থেকে একটা পেন্সিল চুরি করে এনে পিসিকে দেখালো। পিসি বললেন, বেশ করেছিস, সুন্দর, তুই এটা লুকিয়ে রাখ যাতে যার পেন্সিল সে যেন না দেখে। এরপর দিন যায়, রাত যায়, ছেলেটা আজ কারো গাছের আম, তো কাল কারো গাছের সুপারি চুরি করে। আজ এ বাড়ির মুরগি তো কাল ও বাড়ির ছাগল চুরি করে নিয়ে আসে। ছেলেটার পিসি ছেলেটাকে তো নিষেধ করেই না, বরং ওকে প্রশ্রয় দেয়।

এভাবে ছেলেটা আস্তে আস্তে বড় হয়ে গেল। এখন সে আর ছোটখাটো চুরি করে না। ডাকাতি করতে আরম্ভ করলো। এভাবে একবার একজায়গায় ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল। দীর্ঘদিন ধরে তার বিচার হলো। বিচারে ওর ফাঁসির আদেশ হলো। বিচারক ওকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কিছু বলার আছে? ছেলেটা বললো- হুজুর, আমি আমার পিসির সংঙ্গে কথা বলতে চাই। ছেলের পিসিকে আনা হলো আদালতে তার ছেলের কাছে। ছেলের দুই হাত পেছনে বাধা, ছেলে বললো, পিসি আমি তোমার কানে কানে কথা বলবো, তুমি আমার মুখের কাছে তোমার কানটা নিয়ে এসো। পিসি তাই করলো। ছেলে তখন এক কামড়ে পিসির কান ছিড়ে ফেললো। সংগে সংগে পুলিশ এসে ধরে ফেললো ওকে। বিচারক জানতে চাইলেন কেন সে এমন করে তার পিসির কান ছিড়ে ফেললো? ছেলেটি তখন বললো, হুজুর আমি যে আজ ডাকাত হয়েছি তার কারণ আমার এই পিসি। তিনি যদি প্রথম দিন আমাকে চুরি করতে নিষেধ করতো তাহলে আজ আমি এ পর্যায়ে আসতাম না। আমার ফাঁসিও হত না। গল্পটা এখানেই শেষ।

আসুন আমরা আমাদের কান বাঁচাই। আমাদের নিজেদের দোষ ত্রুটি সংশোধন করি। তবেই আমরা আমাদের সন্তানদেরকে সু পথে আনতে পারবো। প্রতিটি বাড়ির বাবা-মা যদি সঠিক চধৎবহঃরহম সম্পর্কে জানেন, শিক্ষক-শিক্ষিকারা যদি আনন্দদায়কভাবে শিক্ষাদান করেন, শিশুদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে চেষ্টা করেন, তাহলে আমরা এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাবো আশা করি। আসলে আমাদের শেকড়েই বিষ। সব শেষে বহু বছর আগে লেখা কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্যরে ছাড়পত্র কবিতার ন্যায় আমিও অঙ্গীকার করে বলতে চাই-

এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তুপ-পিঠে।
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
অবশেষে সব কাজ সেরে,
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আর্শীর্বাদ,
তারপর হবো ইতিহাস।।

আসুন আমার ও কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্যরে মত আপনারা সবাই এই অঙ্গীকারে অঙ্গীকরাবদ্ধ হই।

 

অনুমতি ব্যতিত এই সাইটের কোনো কিছু কপি করা কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয়।

প্রিয় পাঠক অনলাইন নিউজ পোর্টাল দ্যামেইলবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন themailbdjobs@gmail.com ঠিকানায়।

More articles

সর্বশেষ

x  Powerful Protection for WordPress, from Shield Security
This Site Is Protected By
Shield Security