...
শনিবার, এপ্রিল ২৭, ২০২৪

শিক্ষা- অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জাতি গঠনের চাবি-কাঠি

যা যা মিস করেছেন

আব্দুল মান্নান মল্লিক, কলাম লেখক, দ্যা মেইল বিডি ডট কম।

সৃষ্টির প্রাথমিক যুগে মানুষ বনে-জঙ্গলে বসবাস করত। তারা এ সময় মানবেতর জীবন-যাপন করত। পরবর্তীতে বহু বছরের সাধনায় তথা প্রচেষ্টায় মানুষ সভ্যতার আলোকপ্রাপ্ত হয়েছে। সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারা অনুসরণ করে মানুষ ঘর বেঁধেছে, সমাজ গড়েছে। ফলশ্রুতিতে জ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের পথ উন্মোচিত হয়েছে। মানুষের মহিমা সেদিন আকাশস্পর্শী হল, যে দিন অক্ষর সৃষ্টি করে মনের কথাকে শিলায়, পাতায় এবং পরবর্তীতে কাগজের পাতায় চিরন্তন করে রাখার সফলতা অর্জন করল মানুষ। অতঃপর অক্ষরের কালো আঁচরে যুগ যুগান্তরের জ্ঞান পুস্তকের পাতায় অলংকিত হলো।

education the mail bd

বর্তমানে মানুষের জ্ঞান বহুধা বিস্তৃত। পুস্তকের পৃষ্ঠায় অংকিত নানা ভাষার, নানা জ্ঞানের কথা দ্বারা মানুষ নিত্য অধ্যয়নের মাধ্যমে তার জ্ঞান ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। অক্ষর জ্ঞান শূন্য মানুষ ভাষার সাথে, জ্ঞানের সাথে পরিচিত হতে পারেনা। জ্ঞানী হবার প্রাথমিক বা পূর্বশর্ত হচ্ছে অক্ষরের সাথে পরিচয় হওয়া। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর প্রায় সকল মানুষই অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন। অনুন্নত দেশগুলোর মানুষ নিরক্ষরতার অভিশাপের শিকার। আমাদের দেশে নিরক্ষরতার অভিশাপ পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান রয়েছে। নিরক্ষরতা দূরীকরণের বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া সত্বেও এদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী আজও নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারে নাই। জাতীয় জীবনে উন্নতি লাভ করতে হলে জ্ঞান চর্চা করতে হবে। জ্ঞান চর্চার প্রাথমিক বা পূর্বশর্ত হচ্ছে অক্ষরের সাথে পরিচিত হওয়া অর্থৎ লেখা-পড়া শেখা।

শিক্ষা নাগরিকের মৌলিক অধিকার। শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত না হলে নাগরিকের দৃষ্টিভঙ্গি, বুদ্ধিবৃত্তি তথা চেতনার স্ফুরণ ঘটেনা। শিক্ষা এমন এক সৃজনশীল শক্তি যা ব্যক্তির সুপ্ত প্রতিভাকে জাগিয়ে তুলে, ব্যক্তিকে বাস্তববাদী ও যুক্তিবাদী করে গড়ে তুলে। শিক্ষার পরশে মানুষ প্রত্যয়ী ও স্বাবলম্বী হয়ে উঠে। তাই শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগ একটি দেশ বা জাতিকে কত সমৃদ্ধশালী করতে পারে পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহ তার জ্বল-জ্যান্ত প্রমাণ। সাম্প্রতিক কালে উন্নয়নের পথে ক্রমবর্ধমান মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, শ্রিলংকা, সিঙ্গাপুর, চীন প্রভৃতি পূর্ব এশিয় দেশ এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। পক্ষান্তরে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ তথা জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশ শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত বলে দুঃখ, ক্ষুধা, দারিদ্র আর বেকারত্বের গ্লানি নিয়ে দূর্বিসহ জীবন-যাপন করছে। নব্বই দশকের শুরুতে বিশ্ব সমাজ “সবার জন্য শিক্ষা” নিশ্চিত করতে এবং পৃথিবী থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরণে এক ঐতিহাসিক ঘোষণা ব্যক্ত করেন যা “জমতিয়েন ঘোষণা” নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।

উর্বর ভূমি, প্রাকৃতিক সম্পদ আর বিপুল জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত হওয়া সত্ত্বে¡ ও আজ উন্নয়নের দৌঁড়ে বাংলাদেশের পেছনে পড়ে থাকার অন্যতম কারণ হচ্ছে নিরক্ষতা। দেরীতে হলেও সবাই আজ এটা অনুধাবন করতে পেরেছেন। সে কারণে শিক্ষার উপর সর্বাধিক গুরুত্ত্ব দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সময় আর ¯্রােত তো কারো জন্য আর অপেক্ষা করেনা। আমরা যখন হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগুতে চাচ্ছি সেখানে উন্নতশীল বিশ্ব এসময়ে আরও এগিয়ে যাবে। তার মানে আমরা সব সময়ই তাদের চেয়ে পশ্চাৎপদ থাকবো তা কি কখনও মেনে নেয়া য়ায় ? উল্লেখিত কারণে সরকার এদেশ থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরণে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন এবং শিক্ষার উপর ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এ এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আওতায় এ বিরাট কর্মযঞ্জ বাস্তবায়ন একেবারে অসম্ভব, বিধায় সাম্প্রতিক কালে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিশ্ব সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে সরকারের সহায়তায় আন্তরিকভাবে এগিয়ে এসেছে।

যে শিক্ষা নিয়ে এত কথা আর চিন্তা-চেতনা এবার আসা যাক সে শিক্ষার কথায়, তথা শিক্ষার সার্বিক বিশ্লেষণে। ‘শিক্ষা’ শব্দটির তাৎপর্য ব্যাপক ও গভীর । শুধুমাত্র কৌশল আয়ত্ব করাকেই শিক্ষা বলা যায় না। বেঁচে থাকার জন্য কোন কৌশল আয়ত্ব করাকেই শেখা বলে। নিচু স্তরের প্রানীরা শেখে নানা কৌশল আয়ত্ব করে। আর মানুষ সম্পর্কে আমরা ‘শিক্ষা’ শব্দটি ব্যবহার করতে পারি। শুধুমাত্র কোন কিছু শেখা নয়, সমগ্র জীবন ও জগতের মধ্যে সেতু বন্ধন রচনা করার নামই হল শিক্ষা। সমগ্র সত্ত্বার স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশকে সমাজ, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ধারায় সুনিয়ন্ত্রিত করে ব্যক্তির জীবন, পারিপার্শ্বিকতা ও বৃহত্তর জগতের মধ্যে যথার্থ সেতুবন্ধন রচনা করতে পারার অর্থই হল ‘শিক্ষা’। শিক্ষা শব্দটি সংস্কৃত ‘শাস’ ধাতু থেকে উদ্ভূত। যার অর্থ হল শাসন, নির্দেশ, আজ্ঞা, নিয়ন্ত্রণ, তিরস্কার, শাস্তিদান ইত্যাদি। শিক্ষা শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ এডুকেশন (ঊফঁপধঃরড়হ)। এ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ থেকে। ল্যাটিন ভাষায় তিনটি মৌলিক শব্দের সন্ধান পাওয়া যায়, যথা- এডুকেটাম (ঊফঁপধঃঁস), এডুকেয়ার (ঊফঁপধৎব) ও এডুকেয়ার (ঊফঁপবৎব)। এডুকেটাম (ঊফঁপধঃঁস) শব্দের অর্থ হল শিক্ষণ কর্ম, এডুকেয়ার (ঊফঁপধৎব) শব্দটির অর্থ হল লালন-পালন করা এবং এডুকেয়ার (ঊফঁপবৎব) শব্দটির অর্থ হল প্রতিপালন করা বা বিকাশ ঘটানো। এডুকেটাম (ঊফঁপধঃঁস) ও এডুকেয়ার (ঊফঁপবৎব) এ শব্দ দু’টির অর্থ এডুকেয়ার (ঊফঁপধৎব) শব্দ অপেক্ষা সংকির্ণ। এডুকেয়ার (ঊফঁপধৎব) শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ হল “শিক্ষার্থীর অর্ন্তনিহিত শক্তির বিকাশ সাধন”। ক্ষুদ্রতর অর্থে শিক্ষা বলতে বুঝায়-বই পড়ে জ্ঞান অর্জন ও কিছু কৌশল আয়ত্ব করাকে, তথ্য আহরণ, তত্ত্ব জ্ঞান ও পুঁথিগত বিদ্যা অর্জনকে। ব্যাপক অর্থে শিক্ষা বলতে বুঝায় স্বতঃস্ফূূর্ত বিকাশকে। সক্রেটিস ও প্লেটুর মতে, “বিকাশই শিক্ষা”। জন ডিউইর মতে, “শিক্ষা জীবন-যাপনের নামান্তর”। পেষ্টালৎসীর মতে “শিক্ষা স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ প্রক্রিয়া মাত্র। আদর্শ শিক্ষা শিশুর দৈহিক, মানসিক শক্তির সুষম বিকাশ”। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, “শিক্ষা হল, বাইরের প্রকৃতি ও আন্তঃ প্রকৃতির মধ্যে সমন্বয় সাধন”। সুতরাং শিক্ষা হল, “ব্যক্তির জীবনব্যাপী ক্রমবিকাশের অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া যা নিত্য নতুন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তার প্রত্যাশিত আচরণের পরিবর্তন ঘটিয়ে পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে এবং প্রয়োজনবোধে পরিবর্তন সাধনে সমর্থ করে”।

বাংলাদেশের আর্থসামাজিক তথা সার্বিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে শিক্ষা ব্যাবস্থাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা- আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও আনানুষ্ঠানিক শিক্ষা। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অনানুষ্ঠানিক বা আনুষ্ঠানিক উভয় ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থার চেয়ে আলাদা। অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা হচ্ছে সে সব জ্ঞান, দক্ষতা বা আচার-আচরণ যা প্রতিটি মানুষ দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে জীবনভর শিখে থাকে। এটি তুলনামূলকভাবে অসংগঠিত এবং অবিন্যস্ত। রেডিও শোনা, পত্র-পত্রিকা পড়া, দেশ-বিদেশে ভ্রমণ ও সামাজিক যোগাযোগ ইত্যাদি এ ধারার শিক্ষার আওতাভূক্ত। অন্য দিকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা অত্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক, সংগঠিত ও স্তরভিত্তিক। বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার আওতায় রয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা (গ্রেড ১-৫) যা শুরু হয় ৬ বছর বয়সে। জুনিয়র মাধ্যমিক (গ্রেড ৬-৮); মাধ্যমিক (গ্রেড ৯-১০); উচ্চ মাধ্যমিক (গ্রেড ১১-১২) এবং উচ্চতর শিক্ষা (গ্রেড ১২ পরবর্তী)।

উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা হচ্ছে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ধারার বাইরে বিশেষ শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর জন্য প্রনীত এক ধরণের সু সংগঠিত শিক্ষা কার্যক্রম। সাক্ষরতা কর্মসূচি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের দক্ষতা সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ পর্যন্ত এর ব্যাপ্তি। ক্ষুদ্র ঋণ, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পরিবার পরিকল্পণা, সমবায় ও আত্ম কর্মসংস্থানমূলক সামাজিক কর্মসূচি ও এর আওতাভূক্ত হতে পারে। আনুষ্ঠানিক ও উপানুষ্ঠানিক এ দু’ধরণের শিক্ষা ব্যবস্থাই অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রক্রিয়াকে জোরদার করে। প্রক্রিয়াগত ও উদ্দেশ্যের বিচারে দু’ ধরণের শিক্ষার মধ্যে আবার যথেষ্ট মিল রয়েছে। তবে এ দু’ধারার শিক্ষা প্রক্রিয়ার মূল পার্থক্যের অনেকটাই নির্ভর করে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা, বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের ভিন্নতায়।

শিক্ষার সার্বিক বিশ্লেষণ শেষে এবার আসা যাক শিক্ষার ইতিহাসে। শিক্ষার ইতিহান গভিরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, আজকের পৃথিবীতে মানুষের শিক্ষা ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়ে কতকগুলো ধারণা অনেকটা সর্বজন স্বীকৃত মর্যাদা লাভ করেছে, তার মধ্যে রয়েছে- গণতন্ত্র, ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, মানবাধীকার, নারী-পুরুষের সমানাধীকার, শিক্ষা, ন্বাস্থ্য, বাসস্থানসহ এমনি কতকগুলো ধারণা। মাত্র কয়েকশ বছর পূর্বেও এসকল ধারণা আজকের মত এভাবে স্বীকৃতি লাভ করেনি। তার ফলে তখনকার অবস্থা আজকের অবস্থা থেকে ভিন্নতর ছিল। তখন ধরে নেওয়া হত সমাজের সকল ক্ষমতার অধিকারী হল রাজা, জমিদার আর পুরোহিত-মোল্লা শ্রেণী, তারা ঐশি বিধানের বলে তাদের সে অধিকার পেয়েছে। দেশের সাধারণ প্রজাদের কাজ হল কেবল হুকুম তামিল করা আর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দু’মুঠো অন্ন যোগার করা, আর ক্ষেতে খামারে ফসল ফলানো। শিক্ষা আর জ্ঞান থেকে যে শক্তি অর্জন করা যায় তারও অধিকার ছিল কেবল অভিজাত শ্রেণীর লোকদের। পনের শতকে ছাপাখানার উদ্ভব ঘটার ফলে বই-পত্রের মাধ্যমে জ্ঞানের বিস্তার বেশ সহজ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তÍু তারপরও বহু যুগ ধরে সে জ্ঞানের অধিকারী হতে পারত কেবল সমাজের উঁচুতলার মানুষেরা। ধরেই নেওয়া হত যে, খেঁটে খাওয়া মানুষদের তথা চাষা-ভূষোদের জ্ঞানের জগতে প্রবেশ করার অধিকার দেওয়া যায় না। তাতে যদি তাদের চোখ ফুটে গিয়ে মনে বিদ্রোহের ভাব জেগে উঠে ! চাষা-ভূষোদের যদি বা কিছু পড়বার সুযোগ দেওয়া হত, তাও দেওয়া হত খুব সাবধানে ভালোমত যচাই-বাছাই করে।

জাতিসংঘ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তার প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই কথা বলে আসছে ঔপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে, তেমনি সমগ্র পৃথিবীতে সব মানুষের শিক্ষার অধিকার, পরিপূর্ণ আত্মবিকাশের অধিকার নিয়েও হয়ে উঠেছে উচ্চকন্ঠ। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিদেনে গত ১৯৯১ সাল থেকে শুরু করা হয়েছে এই মূলনীতির ঘোষণা দিয়ে- “নারী-পুরুষ-শিশু মিলিয়ে মানুষকে রাখতে হবে সকল উদ্যোগের কেন্দ্র বিন্দুতে, মানুষকে ঘিরে বুনতে হবে সকল উন্নয়ন, উন্নয়নকে ঘিরে মানুষ নয়।” আর এই মূলনীতির স্বীকৃতি থেকেই সারা পৃথিবীতে শিক্ষা বিস্তারের সমস্যা নিয়ে আজ যেমন আলোড়ন চলছে, ইতিহাসে এর পূর্বে আর কখনো এমন হয়নি। আজ এটা ক্রমেই স্বীকৃতি লাভ করেছে যে, সমাজকে গড়তে হলে আগে সে সমাজের মানুষকে গড়বার আয়োজন করা চাই। মানুষের সব রকম প্রতিভা আর ক্ষমতার পূর্ণ বিকাশের জন্য শিক্ষার যে বিড়াট ভূমিকা রয়েছে সে বিষয়ে আজ আর কোন বিতর্ক নেই বা কারও কোন দ্বিমতও নেই। আর তাই সকল মানুষের পরিপূর্ণ আত্মবিকাশের অধিকারের সাথে সাথে শিক্ষার অধিকার ও আজ জাতিসঙ্ঘের মাবাধীকারের সার্বজনীন ঘোষণাতে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বিশ শতক জুড়ে অর্থনীতিবীদরা শিক্ষার অর্থনৈতিক মূল্য নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন। রবার্ট সলো, আর্থার শুলজ, অমর্ত্য সেন প্রমূখ অর্থনীতিবীদ এ ধরণের গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার ও পেয়েছেন। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের যে ক্ষমতার বিকাশ ঘটে তা শুধু ব্যক্তি মানুষের প্রয়োজনেই নয়, দেশ ও জাতির অগ্রগতির জন্যও তা সমানভাবে গুরুত্ত্বপূর্ণ। আর এ কারণেই জাতিসংঘের উদ্যোগে ১৯৯০ সালে বিশ্ব সম্মেলন ডেকে তাতে ২০০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য সার্বজনীন শিক্ষার ব্যাপক আয়োজন করার ডাক দিয়েছিলেন। জাতিসংঘের ডাকে ঐ উদ্যোগে শরিক হয়েছে বাংলাদেশের মত দীর্ঘকাল ধরে ঔপনিবেশিক শাসনের যাতাকলে নিস্পিষ্ট শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে পড়া দেশগুলোও।

প্রাচীনকালেও আমাদের দেশে বেশ বিস্তৃত একটা শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। কিন্তু সে শিক্ষা ছিল অত্যন্ত সাদা-সিধে ধরণের। একজন গুরু বা ওস্তাদের গুটি কয়েক শিষ্য বা সাগরেদ লেখা-পড়া করত সেই শিক্ষা ব্যবস্থায়। প্রথম প্রথম লেখা-পড়া ছিল সাধারনতঃ মুখে মুখে শেখা, তারপর এল তাল পাতায় বা তুলট কাগজে হাতে লেখা পুঁথি। আর শেখা মানে হল প্রধানতঃ মুখস্থ করা, কখনো তার সংগে শিখতে হত “তৈলাধার পাত্র না পাত্রাধার তৈল” এমনি ধারার তর্কের কূটজাল। কি ইউরোপে, কি এই উপমহাদেশে বিদ্যা চর্চা বলতে বুঝাতো প্রধানতঃ ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক শিক্ষা। তৎকালে শিক্ষার আরেক বৈশিষ্ট্য ছিল প্রধানতঃ সমাজের উঁচুতলার মানুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কোন কোন ধর্ম মতে এই সীমাবদ্ধতার গন্ডিগুলো ছিল বেশ কঠোর, যেমন- প্রাচীন আর্য সমাজে। আবার কোথাও সেটা ছিল অনেকটা শিথীল, যেমন- বৌদ্ধ ধর্মে বা ইসলাম ধর্মে। মোঘল সম্রাজ্যের পতনের পর ইংরেজরা এদেশে এল তখন তারাও পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দিতে চেষ্টা করে প্রধানতঃ এদেশের অভিজাত সমাজের লোকদেরকে। অবশ্য আজ এ অবস্থার অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। কালের ¯্রােতধারায় জ্ঞান চর্চার উপর ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকল মানুষের সমানাধিকার আজ এ পৃথিবীর সভ্য সমাজে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

সাম্প্রতিককালে পশ্চিমা জগতের শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে মার্কিন শিক্ষাবিদ জন ডিউই-র ভাবধারা। ডিউই বলেছিলেন, “শিক্ষা শুধু আগামীকালের জন্য প্রস্তুতি নয়, বর্তমান জীবন-যাপনের কলা ও তার আওতাভূক্ত। কাজেই প্রতিটি বর্তমান অভিজ্ঞতাকে অর্থপূর্ণ করে তোলা, সে সকল অভিজ্ঞতা থেকে তাৎপর্য আহরণ করাই হচ্ছে শিক্ষার লক্ষ্য। তবে এ লক্ষ্য অর্জন সমাজকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। কেননা ব্যক্তি মানুষকে নিয়েই সমাজ, আর ব্যক্তির সকল অভিজ্ঞতা নির্ভরশীল সমাজ ও পরিবেশের উপর। কাজেই জীবনের সংগে, সমাজ ও পরিবেশের সংগে যে শিক্ষার যোগ নেই তা অর্থহীন। পূর্বেই সু-স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে শুধু জ্ঞান আর কলা-কৌশল আয়ত্ব করাই শিক্ষা নয়। জীবন, পরিবেশ ও সমাজের প্রয়োজনে তাকে নিয়োগ করাই শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য। এই জীবন, সমাজ ও পরিবেশ বদলে যায় দেশে দেশে, একটি দেশের মধ্যেও বদলে যেতে পারে সময়ের সংগে সংগে। আজ যে আমরা বিশ শতক পেরিয়ে আরেক নতুন শতকে প্রবেশ করেছি তার জন্য ও শিক্ষার বিশেষ ধরনের চাহিদার কথা আমাদের সবাইকে বিবেচনা করতে হচ্ছে। ইউনেস্কোর মহাপরিচালক নব্বয়ের দশকের শুরতে অর্থাৎ ১৯৯৩ সালে বিশিষ্ট ফরাসী বুদ্ধিজীবি জ্যাক দেলরকে সভাপতি করে “একুশ শতকের শিক্ষার জন্য” একটি আন্তর্জাতিক কমিশন নিয়োগ করেছিলেন। এই কমিশন পরবর্তীতে মহাপরিচালকের কাছে তাঁদের রিপোর্ট দাখিল করেছিলেন। “শেখার ভেতরের যে সম্পদ” নামে প্রকাশিত এই রিপোর্টে যে কোন শিক্ষা ব্যবস্থার চারটি মূল স্তম্ভ নির্দেশ করা হয়েছে – জানতে শেখা, করতে শেখা, বাঁচতে শেখা আর মিলে মিশে বাস করতে শেখা। এই চারটি ভিতের উপর প্রতিটি মানুষকে সারা জীবন ধরে শিখে যেতে হবে। শেখার ব্যাপারে বিদ্যালয়ে শিক্ষকের একটা ভূমিকা অবশ্যই থাকবে, কিন্তু আসল শেখাটা ঘটবে শিক্ষার্থীর নিজের চেষ্টায়। আর সে শেখা যে শুধু তার ব্যক্তিত্ব, জ্ঞান আর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাবে তা নয়, সৃষ্টিকরবে তার বিশ্লেষণ ক্ষমতা আর তার সাথে সাথে কাজ করবার ক্ষমতাও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগামে আমরা দেশের সমগ্র জনগণের বিকাশকে আমাদের সংগ্রামের মূল লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম। আর এই লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে শিক্ষাকে একটি প্রধান অবলম্বন হিসেবে দেখা হয়েছিল। সে জন্যই স্বাধীনতা লাভের পর-পরই দেশের নতুন সরকার ডঃ কুদরাত-এ খুদার নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন নিয়োগ করেছিলেন। এই কমিশন যে সকল কথা বা সুপারিশ উপস্থাপন করেছিলেন তার মধ্যে দেশের সকল স্তরের মানুষের শিক্ষার কথা বেশ প্রাধান্য পেয়েছিল। সম্প্রতি যে শিক্ষানীতি প্রনয়ন কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে তাতেও সার্বজনীন শিক্ষাকে অতি দ্রুত সাফল্যমন্ডিত করে তোলার কথা বেশ গুরুত্বের সাথে বলা হয়েছে। তবে এসকল বিষয়ে শুধু নীতিতে কথাটা থাকাটাই যথেষ্ট নয়, তাকে কাজে পরিনত করাই আমাদের বেশী জরুরী।

গত কয়েক দশকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অর্থনীতিবীদদের নানা গবেষণার ফলে এ সত্য আজ সকল মহলে স্বীকৃতি লাভ করেছে যে, দেশের অর্থর্তনৈতিক প্রবৃদ্ধির সেরা উপায় হল দেশের জনশক্তিকে আজ ও আগামীদিনের সমাজের প্রয়োজনানুযায়ী গড়ে তোলা। বিশ্বকবি রবিন্দ্রনাথ বলেছিলে, “শিক্ষার লক্ষ্য হল মানুষকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দান করা।” আমাদের যে শক্তি আছে তারই চরম বিকাশ হবে, আমরা যা হতে পারি তা সম্পূর্নভাবে হব-তাই হবার কথা শিক্ষারই ফল। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের সর্বাঙ্গিন বিকাশ, দাসত্ব থেকে মুক্তির লক্ষ্যে শিক্ষার আলো তথা শিক্ষার দ্বীপ শিখা সমগ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। ছড়িয়ে দিতে পারলে কেবল তখনই আমরা অর্থনৈতিক ও সামাজিকসহ সকল ক্ষেত্রে স্বয়ংম্ভরতা অর্জন করতে সামর্থ হবো এবং পৃথিবীর বুকে একটা গর্বিত জাতি হিসেবে আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো।

অনুমতি ব্যতিত এই সাইটের কোনো কিছু কপি করা কপিরাইট আইনে দণ্ডনীয়।

প্রিয় পাঠক অনলাইন নিউজ পোর্টাল দ্যামেইলবিডি.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন themailbdjobs@gmail.com ঠিকানায়।

More articles

সর্বশেষ

x  Powerful Protection for WordPress, from Shield Security
This Site Is Protected By
Shield Security
Seraphinite AcceleratorOptimized by Seraphinite Accelerator
Turns on site high speed to be attractive for people and search engines.