অনুপম পাল বাঁশখালী প্রতিনিধি
আমরা সকলেই হয়ত এই ব্যাপারে অবগত আছি যে বাংলাদেশে কোন হিন্দু কন্যা সন্তান তার পিতার সম্পত্তিতে একচ্ছত্র উত্তরাধিকারী হন না দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী। বাংলাদেশে প্রচলিত হিন্দু আইনে কন্যা সন্তানকে বিবাহ দেওয়ার মাধ্যমেই একজন পিতা দায়মুক্ত হন এবং পরবর্তীতে সে আর পিতার সম্পত্তিতে কোন অংশীদার হিসেবে পরিগণিত হন না।
হিন্দুদের মহাপবিত্র এবং প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদে এই ব্যাপারে বেশ কিছু রেফারেন্স দেওয়া আছে যেখানে দেখা যায় নারী পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেক সন্তান পিতা-মাতার নিকট সমান অধিকার এর দাবিদার। এ ব্যাপারে ঋকবেদের ৩.৩১.২ অনুযায়ী ‘’পিতা মাতার স্নেহের অধিকার পুত্র এবং কন্যা উভয় সন্তানেরই সমান এবং তারা উভয়ই সমান দামী। বিয়ে হলেই মেয়ে তার পিতা- মাতার বাড়ি হতে আলাদা হয়ে যায় না তাকে আলাদা করে ধন নয় বরং শিক্ষা ও সম্পদে পরিপূর্ণভাবে তৈরি করে তাকে প্রেরণ করা হয়’’।
ঋকবেদের ৩১ নং সুক্তের ২নং মন্ত্রে বলা হয়েছে আলাদা করে কন্যার বরকে সুক্ষ ধন দেওয়া নয় বরং সেই কন্যা যেন সন্তান জন্ম দিয়ে তাকে যাতে পূর্ণরূপে মানুষ করে গড়ে তুলতে পারে সেই শিক্ষায় আলোকিত করে দিতে হয়। এর মাধ্যমে বোঝা যায় মহা পবিত্র বেদে নারীদেরকে কতটা সম্মানিত করা হয়েছে এবং কখনোই তাকে পুত্র সন্তান হতে পৃথক করা হয়নি তাকে শিক্ষা দানের মাধ্যমে প্রকৃত সম্পদ রূপে পরিণত করার কথা বলা হয়েছে।উল্লেখ্য যে, এখানে যৌতুক প্রথাকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আবার, হিন্দু ধর্ম মতে স্ত্রী ধন এমন একটি সম্পদ যা একান্তই একজন নারীর ব্যক্তিগত এবং তার অনুমতি ব্যতীত কেউ তা ব্যবহার বা হস্তক্ষেপও করতে পারেন না। কিন্তু, প্রকৃত অর্থে হিন্দু নারী তার প্রাপ্য স্বাধীন স্ত্রীধন কি সত্যিই স্বাধীনভাবে ব্যবহার করতে পারেন বা করলেই কতটুকু পারেন । কেননা আমাদের সমাজ অনেক ক্ষেত্রেই তা করতে দেয় না কিন্তু এটি সম্পূর্ণরূপে ধর্মবিরোধী।
মনু সংহিতার ৩.৫২ নং শ্লোকে বলা হয়েছে ‘’কন্যার পতি বা শ্বশুরবাড়ির লোক কন্যার সম্পত্তি, বিবাহের সময় প্রাপ্ত স্ত্রীধন পেতে চাইলে সেই পাপাচারিগণ অধোগতি লাভ করেন’’। এখানে এটা স্পষ্ট যে বরপক্ষ কর্তৃক কোন প্রকার যৌতুক চাওয়া বা গ্রহণ করা হিন্দু ধর্মীয় নীতিতে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং কন্যার প্রাপ্ত স্ত্রীধনের উপর একমাত্র অধিকার কন্যার নিজের। পবিত্র বেদে বেদের নির্দেশনা অনুসরণ করে ১৯৫৬ সালে হিন্দু সাকসেশন ল’ এর মাধ্যমে ভারতে হিন্দু পুত্র-কন্যা নির্বিশেষে পিতার সম্পত্তিতে উভয়ের সমান অধিকার নিশ্চিত করেছেন ভারতীয় সরকার।
কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরেও বাংলাদেশের হিন্দু নারীদের সম্পত্তিতে একচ্ছত্র অধিকার দেওয়া হয়নি আজ অবধি। এখনো বাংলাদেশের দায়ভাগা আইন অনুসারে একজন বিধবা নারী তার স্বামীর সম্পত্তিতে কেবলমাত্র জীবন সত্ত্বের মালিক এবং একজন অবিবাহিত কন্যা ও পুত্রবতী কন্যা তার পিতার সম্পত্তিতে জীবন সত্ত্বের মালিক। সম্পত্তি হস্তান্তর বা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে এই সকল নারীদেরকে যতটুকু সুযোগ দেওয়া হয়েছে তা অনেক সময়ই প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল।
আমরা যদি আবার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান এর কথা বিবেচনা করি তাহলে দেখতে পাই যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে আইনের দৃষ্টিতে সমতার বিধান অর্থাৎ সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ধর্মীয় বৈষম্যহীনতার কথা। কেবল ধর্ম গোষ্ঠী বর্ণ নারী পুরুষ ভেদে বা জন্ম স্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।
রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন। নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত করিবেনা।
অর্থাৎ এখানে স্পষ্টত বলে দেওয়া হয়েছে যে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি নাগরিক সমান অধিকার ভোগ করবে এবং এক্ষেত্রে যদিওবা হিন্দু নারীরা তাদের সম্পত্তির একচ্ছত্র উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত সেক্ষেত্রে কিন্তু রাষ্ট্র নিজ উদ্যোগে বিশেষ বিধান প্রণয়ন করে এই অনগ্রসর অংশকে অগ্রগতির দিকে ধাবিত করতে পারেন।
যেটি অবশ্যই সংবিধান পরিপন্থী নয়। এছাড়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৪২ অনুচ্ছেদে সম্পত্তির অধিকারের কথা বলা হয়েছে এবং সেখানেও নারী পুরুষকে বৈষম্য করা হয়নি।
দেশের প্রচলিত এই হিন্দু পারিবারিক আইনের সংস্কার আনার লক্ষ্যে ২০১২ সালে হিন্দু পারিবারিক আইন সংস্কারের সুপারিশ বিষয়ক চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশে এই আইন সংস্কার না হওয়ার পেছনে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে ও রাষ্ট্রীয় সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণ রয়েছে ।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের প্রচলিত হিন্দু আইনের অনেক কিছুই প্রথাভিত্তিক। ব্রিটিশ আমলে প্রচলিত সতীদাহ প্রথার কথা যেটি প্রকৃতপক্ষে হিন্দুদের কোন ধর্মগ্রন্থ সাপোর্ট করত না কিন্তু তা প্রথা হিসেবে প্রচলিত ছিল পরবর্তীতে মহর্ষি রাজা রামমোহন রায় এই সতীদাহ প্রথা বন্ধ করে মানবিকতার জয় গান গেয়ে গেয়েছেন ।
আবার আমরা বিধবা বিবাহের কথা বলতে পারি যেখানে বিধবা বিবাহ ধর্মীয় বিধানে অনেক ক্ষেত্রে সিদ্ধ।ঋকবেদের ১. ১৮.৭-৮ এ বলা হয়েছে স্বামীর মৃত্যুতে অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল বা সামাজিকভাবে সমস্যার সম্মুখীন বিধবা মহিলাকে পুনর্বিবাহের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
পরাশর সংহিতার ৪.৩০ অনুযায়ী নারীর যদি স্বামী মারা যায়, স্বামী যদি গোপনে সন্ন্যাস গ্রহণ করে, নিখোঁজ হয়ে যায়, সন্তান উৎপাদনে ব্যর্থ হয়, অধার্মিক ও অত্যাচারী হয় তবে নারী পুনরায় বিবাহ করতে পারে।বিধবা বিবাহের পক্ষে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্তৃক গৃহীত উদ্যোগে পক্ষে স্বাক্ষর ছিল ৯৮৭ টি আর বিপক্ষে স্বাক্ষর ছিল ৩৬,৭৬৩ টি। অর্থাৎ অনেক সময় দেখা যায় যে ‘’Majority wins’’ কথাটি সব ক্ষেত্রে সঠিক নাও হতে পারে।
অনেকে মনে করেন হিন্দু নারীদেরকে সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার চূড়ান্তভাবে দিলে তাদের ভেতরে ধর্মান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে।
কিন্তু প্রকৃত অর্থে ধর্মান্তরিত ব্যক্তি কোন ভাবেই সম্পত্তি পাবে না ধর্মান্তরিত ব্যক্তি সম্পত্তি পাওয়ার আগে ধর্মান্তরিত হলে তার প্রাপ্য সম্পত্তি তার ধর্মান্তর না হওয়া ভাই বোন হিন্দু স্ত্রী বা স্বামী সন্তান পাবে। মনুসংহিতায় বলা হয়েছে ধর্মান্তরিত ব্যক্তি সম্পত্তির উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হবেন।
এখানে উল্লেখ্য যে ১৮৫০ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে Cast Disabilities Removal Act নামে একটি আইন প্রণীত হয়েছিল যেখানে ধর্ম পরিবর্তিত হলেও কোন ব্যক্তি সম্পত্তির উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হতেন না।
কিন্তু বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার বাংলাদেশ স্বাধীনের পূর্বের কিছু আইন বাতিলের সিদ্ধান্ত নেন যার মধ্যে The Caste Disabilities Removal Act, 1850 আইনটি উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৩ সালে এই উদ্দেশ্যে Bangladesh Laws Revision and Declaration act 1973 প্রণীত হয়।
এর অর্থ এই যে, এই আইন প্রণীত হবার পর থেকে বাংলাদেশে পূর্বের প্রচলিত The Caste Disabilities Removal Act, 1850 বহাল নেই অর্থাৎ হিন্দু পার্সোনাল ল’ বহাল থাকছে, মানে ধর্মান্তরিত হলে কোন ব্যক্তি হিন্দু বা মুসলিম নির্বিশেষে সে তার উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন।
অর্থাৎ এখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে ধর্মান্তরিত হবার ভয়ে মেয়েদেরকে সম্পত্তির উত্তর অধিকার থেকে বঞ্চিত করা সম্পূর্ণরূপে অযৌক্তিক যেখানে ধর্মান্তরিত হবার পর অটোমেটিক্যালি কোন স্ত্রী বা পুরুষ তার সম্পত্তির অধিকার হতে বঞ্চিত হবেন।
পরিশেষে এটুকু বলা যায় রাষ্ট্র এবং প্রগতিশীল সমাজে এটুকু আমরা আশা করতে পারি যে ধর্মের সাথে মিল রেখে যেখানে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এবং নেপালে নারীদেরকে সমানভাবে সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার দিয়েছে সেখানে ধর্মীয় বিধান খর্ব করা হয়নি তাই বাস্তবতা নিরিখে এবং বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে বাংলাদেশের হিন্দু নারীদেরকে ধর্মীয় বিধান এবং সংবিধান অনুযায়ী সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করলে দেশ জাতি এবং রাষ্ট্রের মঙ্গল বয়ে আনবে। সবশেষে আমরা এটুকুই বলতে চাই যে আমরা ধর্মীয় বিধানের পরিপন্থী কোন আইন চাই না আমরা চাই ধর্মীয় বিধানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে হিন্দু আইনে একটি সংশোধন এবং সংযোজন, যা অবশ্যই হিন্দু ধর্ম এবং দেশের প্রচলিত সংবিধান