তাসলিমুল হাসান সিয়াম: গাইবান্ধায় কথিত এনজিও ও দাদন ব্যবসায়ীদের ঋণের জালে আটকা পড়েছে সাধারণ মানুষ। অনুমোদনহীন এসব এনজিও গ্রাহকদের জিম্মি করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করছে । তাদের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলতে গেলে মামলা, হামলা, জমার কাগজপত্র আটকে রাখাসহ নানা হয়রানির শিকার হন অভিযোগকারীরা। এসব সমিতির উদ্যোক্তারা প্রভাবশালী হওয়ায় অসহায় এখন ভুক্তভোগীরা।
এই ঋণের ফাঁদে শুধু নিম্নবিত্ত নয়, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্তরাও আটকা পড়ে যাচ্ছে। প্রচলিত ব্যাংকের সুদ হার কম হলেও সেখান থেকে ঋণ পাওয়া সহজ নয়। ফলে তার উচ্চ সূদ হারে অপ্রচলিত, ব্যক্তিখাত এবং এনজিও থেকে ঋণ নিচ্ছেন। ওই ঋণের সুদ আর কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে এখন তারা দিশেহারা।
অনুসন্ধানে জানা যায় জেলার বেশির ভাগ পরিবার ঋণের জালে জর্জরিত। নদীভাঙন ও বন্যাকবলিত এ এলাকার দরিদ্র মানুষেরা ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন নিয়ে এনজিও থেকে ঋণ তুলছে। কিন্তু আর্থিক সংকট চলমান থাকায় সঠিকভাবে কিস্তি পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে বাধ্য হয়ে অন্য এনজিও থেকে আবার ঋণ তুলছে। এতে ঋণের চক্রে পড়ে দাদন ব্যবসায়ীদের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে তাদের। মহাজনদের কাছ থেকে অতিরিক্ত সুদে বা কম মূল্যে আগাম ফসল বিক্রি করে টাকা নিয়ে কিস্তি পরিশোধ করছে। এভাবে তাদের ঋণের বোঝা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এক ঋণ থেকে বাঁচতে অন্য ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে তারা। পরে গৃহবধূর স্বর্ণালংকার, গবাদি পশু, ছাগল ও হাঁস-মুরগি বিক্রি করেও পার পাচ্ছে না অনেক পরিবার। বাধ্য হয়ে শেষ সম্বল বাপ-দাদার বসতভিটা বিক্রি করে দিতে হচ্ছে তাদের।
এদিকে ঋণের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যার সংখ্যাও বাড়ছে ।গত বছরে ২৭ এপ্রিল গাইবান্ধা সদর উপজেলার খোলাহাটি ইউনিয়নের রথেরবাজার (জেলাল পাড়া) গ্রাম থেকে কোব্বাস আলী নামের এক বাস চালক আত্নহত্যা করেন তার পরিবার জানায়, দশানি গ্রামের দাদন ব্যবসায়ী সোনা মিয়ার কাছে সুদে ৩০ হাজার টাকা নেন কোব্বাস আলী। দেড় বছর পর কোব্বাসের কাছে এক লাখ ২০ হাজার টাকা দাবি করেন দাদন ব্যবসায়ী সোনা মিয়া। টাকা দিতে না পারায় শনিবার কোব্বাসকে বেধড়ক মারপিট করা হয় । একপর্যায়ে তিনি হতাশায় নিজ ঘরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন ।
চলতি ২০২৩ সালের ১১ জানুয়ারি গোবিন্দগঞ্জের সুদের টাকা দিতে না পেয়ে ৩ সন্তানে জননীর আত্মহত্যা করেছেন ।এলাকা বাসি জানিয়েছে, উপজেলার কাটাবাড়ী ইউনিয়নের বিশুলিয়া কাটাবাড়ী গ্রামের আনিসুর রহমানের স্ত্রী ৩সন্তানের জননী অজুফা বেগম(৩৫) এলাকার সুদ ব্যবসায়ীর নিকট থেকে সুদের টাকা নিয়ে অন্য মহিলাকে দিলে সে সময় মতো পরিশোধে ব্যর্থ হলে দাদন ব্যবসায়ী নিয়মিত চাপ দিলে নিজ বাড়ির খড়ির ঘরে গলায় রশি বেঁধে আত্মহত্যা করেন ।
অন্যদিকে দাদন ব্যবসায়ীদের ঋণের ফাঁদে পড়ে সর্বশান্ত হয়ে নিজের ডেইরি ফার্ম বন্ধ করেছে গাইবান্ধা সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের তরুণ উদ্যোক্তা খোকন রহমান । তিনি জানান করোনায় কোচিং সেন্টার বন্ধ হয়ে গেলে বিকল্প আয়ের পথ হিসেবে ডেইরি ফার্ম তৈরি করেন । নিজের পৈত্রিক সম্পত্তি বন্ধক ও স্থানীয় দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋন নিয়ে শুরু করেন বিদেশি গরুর খামার । কিন্তু পশুখাদ্যর দাম বৃদ্ধি এবং দাদন ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধের চাপে ফার্ম চালাতে হিমশিম খেয়ে এক পর্যায়ে সমস্ত গরু বিক্রি করেও চড়া সুদের অর্থ যোগাতে ব্যার্থ হয়েছেন তিনি । তিনি জানান আমার ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য এখন ব্যাংক ঋণের প্রয়োজন কিন্তু ব্যাংকের ঋন পাওয়ার প্রক্রিয়া বেশ জটিল আমার অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও কোন ব্যাংক আমাকে ঋন দিতে আগ্রহী নন । এমন অবস্থা চলমান থাকলে তরুন উদ্যোক্তারা এই খাতে আসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে ।
গাইবান্ধা সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাহনেওয়াজ শুভ জানান , উদ্যোক্তাদের উচিত দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ না নিয়ে ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদের ঋণ নেওয়া । এক্ষেত্রে ব্যাংকের ঋণ বিতরণের জটিল প্রক্রিয়াগুলো আরও সহজ করতে হবে ।