শীতের দিনে কোন খাবার খাবেন, বাঙালিকে সেটা বলে কোনো লাভ নাই। কারণ প্রবাদ বলে, বাঙালি খাদ্যরসিক জাতি। রসেবশে থাকতেই ভালোবাসে তারা। সুখের দিনেও তাদের খাবার লাগে, এন্তার দুঃখকষ্ট ভুলতে ওই খাবারই লাগে। নইলে প্রতিটা শহরে ব্যাঙের ছাতার মতো রেস্তোরাঁ গজায়! কাজেই শীতের দিনে তাদের ঝোলা থেকে বেরোবে একটার পর একটা খাবারের রেসিপি আর তার অত্যাশ্চর্য গল্প, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি অন্তত হই না।
শীত মানেই নতুন চাল। নতুন চাল মানেই পিঠাপুলি। শুধু পিঠাপুলিই বা হবে কেন। এই ধরুন না, শীত মানেই চালের আটা দিয়ে বানানো ছিটা পিঠা আর হাঁসের মাংস ভুনার কথা! আহা, এ ছাড়া শীত পুরো হবে কেন! এই একটা আইটেমে কি আর বাঙালির মন ভরবে? ভরবে না। তাই একটু এপাশ-ওপাশে যাওয়া যাক।
দুধসাদা চীনামাটির বাটিতে ধোঁয়া ওঠা গরম ঘন সুরুয়া আর তার ওপর ভাসা খাসির পায়ার কথা কি ভুলে গেলে চলবে এই শীতে? আহা, তার সঙ্গে যদি থাকে চালের আটার গরমাগরম রুটি, স্বাদটা যদি একটু ঝাল ঝাল হয়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। এই যে খাসির পায়া নামের খাবারটা এত আবেশ নিয়ে খাচ্ছেন, এটাকে আবার নিহারিও বলা হয়। কিন্তু মনে রাখবেন, নিহারি আর পায়ার মধ্যে সূক্ষ্ম তফাত আছে। রসিক ছাড়া সে তফাতটা ধরা মুশকিল। এ তফাতের মূল বিষয় মসলা। আর নিহারিতে খাসি, ভেড়া বা গরুর পায়ার সঙ্গে থাকবে বিভিন্ন তরুণাস্থি অর্থাৎ নরম হার। সলিড কোনো মাংস থাকবে না। সারা রাত ধরে রান্না হতে হতে সব হার নরম হয়ে যাবে।
এই ফাঁকে বলে রাখি, নিহারি নামের খাবারটির জন্ম হয়েছে মোগল ভারতে। ধারণা করা হয়, হায়দরাবাদ বা পুরোনো দিল্লিতে এর জন্ম। এটি সকালবেলার খাবার। অর্থাৎ সারা রাত ধরে রান্না করে সকাল বেলা পরোটা বা রুটি দিয়ে এটি খাওয়া হবে- এটাই ছিল নিয়ম। এখনো নেহারি সকাল বেলা পরোটা বা রুটি দিয়েই খাওয়া হয়।
নিহারির বৈশিষ্ট্য, এটা দীর্ঘ সময় ধরে রান্না করা হয়। মোগল হেঁশেলেও এটি প্রায় সারা রাত ধরে রান্না করা হতো। সুস্বাদু আর উত্তম মানের নিহারি খেতে গেলে আপনাকে অন্তত একটি রাত সময় দিতে হবে। ধীরে ধীরে জ্বাল দিয়ে রান্না করতে হবে নিহারি। একসময় দেখবেন, শক্ত হাড়ও কেমন গলে গেছে। আক্ষরিক অর্থেই মুখে দিলে মাখনের মতো গলে যাবে। আর পায়ায় শুধু খাসি, ভেড়া বা গরুর পা–ই থাকবে। বাড়িতে খাওয়ার জন্য এর সঙ্গে অল্প অল্প করে যোগ করতে ফুলকপি, শালগম, বাঁধাকপি। তবে খেয়াল রাখতে হবে, এগুলোর যেটাই যোগ করুন না কেন, স্বাদে কিন্তু পরিবর্তন হতে থাকবে।
বহুত আলাপ করা হলো। এবার চলুন একেবারে চলতি একটা রেসিপি আপনাদের বলে দিই। বাড়িতে রান্না করতে পারবেন।
উপকরণ খাসি অথবা গরুর পায়া ১ কেজি, এলাচি, দারুচিনি, তেজপাতা কয়েকটা, পেঁয়াজবাটা, আদাবাটা, রসুনবাটা, ঝোল ঘন করার জন্য পোলাওর চালের গুঁড়া, লবণ স্বাদমতো, মরিচগুঁড়া, জিরাগুঁড়া, হলুদগুঁড়া, ধনেগুঁড়া, গোলমরিচ, তেঁতুলের পিউরি, পেঁয়াজ বেরেস্তা, আদাকুচি, পুদিনাকুচি, লেবুর রস। সব উপকরণ দেবেন পরিমাণমতো। এই পরিমাণটা নির্ধারণ করবেন কজন মানুষ খাবেন, তার ওপর নির্ভর করে।
প্রণালি:
পায়া পরিষ্কার করে ধুয়ে ৮ থেকে ১০ কাপ পানি, আদাবাটা, রসুনবাটা, পেঁয়াজবাটা, গরমমসলা, হলুদগুঁড়া, মরিচগুঁড়া, গোলমরিচ—সব একসঙ্গে মৃদু আঁচে ৯-১০ ঘণ্টা (বা তারও বেশি সময়) চুলায় ঢেকে রাখুন। পায়া সেদ্ধ হলে তাতে স্বাদ, পছন্দ ও পরিমাণমতো সবজি যোগ করতে পারেন। খাবার সময় আদাকুচি, পুদিনা, লেবুর রস ও বেরেস্তা ওপরে ছড়িয়ে গরম-গরম খেতে হবে।
এবার শুভদিন দেখে রেঁধে ফেলুন খাসির পায়া বা নিহারি, যেটা আপনি বলতে পছন্দ করেন।