ছাত্রজীবনের অধ্যায় সমাপ্তি ঘটিয়ে বিসিএস দিয়ে চলে আসি পুলিশে৷ ধ্যানজ্ঞান ছিল মানুষের পাশে থেকে, তাদের সাথে জড়িত হয়ে কাজ করা। পুলিশের পেশা একমাত্র পেশা যেখানে সমাজের সর্বস্তরের লোকের পাশে থেকে তাদের জন্য কাজ করার সুযোগ লাভ করা যায়।
চাকুরি জীবনের শুরুতেই প্রথম পোস্টিং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে। ২০১৩ সালের প্রথম দিকে প্রথম পোস্টিং ডিএমপির এসি (পেঃ) মতিঝিল হিসেবে শুরু হয়েছিল আমার পথচলা। তখন উত্তাল রাজনৈতিক অবস্থা। ধর্মান্ধ জনগোষ্ঠী সে সময় শান্ত ঢাকাকে উত্তাল করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলাম ঢাকার প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলকে ওদের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের জন্য বাছাই করে৷
শাপলা চত্বর থেকে শুরু হয় ওদের আক্রমণাত্মক কাজকর্ম। নির্বিচারে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, বিভীষিকাময় অবস্থা তখন।
৫ মে হেফাজতের তাণ্ডবলীলার সময় একটানা ৩০ ঘণ্টা ডিউটি করেছি। ২৪ ঘণ্টা নির্ঘুম। রাত দিনের পার্থক্য হারিয়ে ফেলি। বাংলাদেশ পুলিশ এর প্রাণপ্রিয় অভিভাবক পরম শ্রদ্ধেয় ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ, জনাব ড. বেনজীর আহমেদ বিপিএম (বার) স্যারের নির্দেশে, অতিরিক্ত আইজিপি শেখ মারুফ হাসান স্যার ও ডিআইজি আনোয়ার হোসেন স্যার, ডিসি মেহেদী হাসান স্যার, ডিসি ওয়ারী ইফতেখার স্যারসহ অন্যান্যদের নিয়ে বুক চিতিয়ে লড়াই করেছিলাম ওইদিন। শপথ ছিল বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী। যে করেই হোক ধর্মান্ধ জনগোষ্ঠী, উগ্রপন্থীদের থামাতে হবে। কখনো শাহ আলম মুরাদ সাহবের সাথে আওয়ামী লীগ এর পার্টি অফিসকে নিরাপদ রাখা আবার কখনো ওসি মতিঝিল ফরমান আলীর উদ্বিগ্ন কণ্ঠ শুনে মতিঝিল থানায় ফোর্স নিয়ে হাজির হয়ে থানা ও ফোর্সদের নিরাপদ রেখেছিলাম। কখনো পল্টন মোড় আবার কখনো পল্টন থানা আর সর্বশেষ শাপলা চত্বর। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যায় এক সময়। স্বাভাবিক হবার আগের সময়টা ছিল আমার ব্যক্তিগত জীবনের জন্য খুব স্মরণীয়। আমার বিয়ের বয়স তখন ৪ মাস ২৩ দিন। বয়সেও তরুণ। আমার সহধর্মিণী রিংকির ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে খুব ভয়ার্ত কণ্ঠ। বললো, তুমি সাবধানে থাকো।
অনেকক্ষণ ফোন বাজার পর একবার সুযোগ পেলাম কলটা রিসিভ করার। ওপাশ থেকে হাউমাউ করে কান্নার আওয়াজ। যা বললো তার সারমর্ম হলো আমিতো ডাক্তার। আমি তোমাকে খাওয়াবো; তুমি চলে এসো প্লিজ। ততক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিলাম, এত কান্নাকাটি করতে থাকলে দায়িত্ব পালন করা কঠিন। ওকে বললাম, আমার ফোনে চার্জ নাই। বন্ধ হয়ে গেলে দুশ্চিন্তা কইরো না। দোয়া কইরো।
ব্যক্তিগত ফোনটা বন্ধ করে দিলাম। সেই ফোনের পর পরদিন সকালে কথা হলো ওর সাথে।
আমি যখন ঘুমিয়ে থাকি রাতের বেলা জরুরি ডিউটি হলে সে কিন্তু চলে যায়। রাতের পর রাত জেগে দায়িত্ব পালন করে। আমাদের দাম্পত্য জীবনের আজ ৯ বছর চলছে। কোনোদিন প্রশ্ন আসে নাই, ‘ডাক্তার বড় না, পুলিশ বড়?’ আমরা সুখে আছি। আলহামদুলিল্লাহ।
আমার মতে, সব পেশাই বড়। শুধু দরকার ত্যাগ। আমার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করা আর আমার মিসেসের রাতের পর রাত জেগে বহুপ্রাণকে রক্ষা করা দুটোই অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
কভিড-১৯ মহামারীর শুরুর দিকে আমি নারায়ণগঞ্জ জেলায় ডিউটি করি। তখন রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত ছিল আমার দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকা। ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি পরম শ্রদ্ধেয় হাবিবুর রহমান বিপিএম (বার), পিপিএম (বার) স্যারের দিক নির্দেশনা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ডেডিকেশন নিয়ে কাজ করে করোনার প্রথম ঢেউ মোকাবিলা করেছিলাম। আমি আমার স্ত্রী-সন্তানদের সান্নিধ্য পাই নাই করোনার প্রথম ঢেউ মোকাবেলায় প্রথমসারীর কর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে। আমার সহধর্মিণীও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে তার পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছে।
মানুষ খারাপ হতে পারে, চারিত্রিক আচরণে ঝামেলা থাকতে পারে। কিন্তু ব্যক্তির দায় কখনোই প্রতিষ্ঠানে বা তার প্রতিনিধিত্ব করা পেশার উপর নির্ভর করে না।
এদেশটা আমাদের। কে বড় আর কে ছোট এ বিতর্কে না গিয়ে আসুন আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের জন্য কাজ করি।
লেখক : অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, বাংলাদেশ পুলিশ