জিলহজ মাস। আরবি সর্বশেষ মাস। এ মাস অনেক ফজিলতপূর্ণ একটি মাস। বেশ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী একটি মাস। জিলহজ মাসের প্রথম দশকের ফজিলত সম্পর্কে রাসূলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন―এমন কোনো দিন নেই, যে দিনের ইবাদত আল্লাহর কাছে জিলহজের প্রথম দশকের ইবাদতের চেয়ে বেশি প্রিয়। জিলহজ মাসের প্রথম দশকের প্রত্যেক দিনের রোজা এক বছর রোজা রাখার সমতুল্য। আর প্রত্যেক রাতের ইবাদত লাইলাতুল কদরের ইবাদতের সমতুল্য। (সহিহ বুখারি: ৯০৬)
জিলহজ মাসের গুরুত্বপূর্ণ কিছু আমল পেশ করা হলো-
এক. বেশি বেশি তাওবা করা: তাওবার মর্মকথা হলো―আল্লাহ তাআলার নাফরমানি থেকে ফিরে আসা, আল্লাহর হুকুমের পাবন্দি করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা এবং অতীতের কৃতকর্মের ওপর অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়ে তা ছেড়ে দেওয়া এবং না করার দৃঢ় সংকল্প করা। কুরআনে বিবৃত হয়েছে, হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তওবা কর—বিশুদ্ধ তওবা; সম্ভবত তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের মন্দ কাজগুলো মোচন করে দেবেন এবং তোমাদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। সূরা তাহরিম: ৮
দুই. রোজা রাখা: জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন রোজা রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। যেহেতু অন্যান্য আমলগুলোর মধ্যে রোজা অন্যতম, তাই এ দিনগুলোতে খুব যত্নসহকারে রোজা করা উচিত। হাদিস শরিফে বিবৃত হয়েছে, হাফসা রা: বর্ণনা করেন―রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো চারটি আমল পরিত্যাগ করেননি। সেগুলো হল: আশুরার রোজা, জিলহজের দশ দিনের রোজা, প্রত্যেক মাসে তিন দিনের রোজা, ও ফযরের পূর্বের দুই রাকাত নামাজ। আবু দাউদ: ২১৯৬, নাসায়ী: ২২৩৬।
অন্য হাদিসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন―“যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় একদিন রোজা রাখবে, একদিনের রোজার বিনিময় তার চেহারাকে জাহান্নামের আগুন থেকে সত্তর খারিফ দূরে রাখবে” সহিহ বুখারি: ২৮৪০, সহিহ মুসলিম: ১১৫৩।
তিন. হজ ও ওমরা করা: রাসূলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দুটি মর্যাদাপূর্ণ ইবাদতের জন্য উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন। হাদিস শরিফে বিবৃত হয়েছে, রাসূলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন―যে ব্যক্তি হজ করেছে, তাতে কোনো অশ্লীল আচরণ করেনি ও কোনো পাপে লিপ্ত হয়নি সে ওই দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে গেলো, যেদিন তার মাতা তাকে প্রসব করেছে।’ সহিহ বুখারি: ১৪৪৯, সহিহ মুসলিম: ১৩৫০।
অন্য হাদিসে এসেছে আবু হুরয়রাহ রা: বর্ণনা করেন, যে রাসূলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন―‘এক ওমরাহ থেকে অন্য ওমরাহকে তার মধ্যবর্তী পাপসমূহের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। আর কলুষযুক্ত হজের পুরস্কার হল জান্নাত।’ সহিহ বুখারি: ১৬৮৩, সহিহ মুসলিম: ১৩৪৯।
চার. আল্লাহর যিকির করা: এ দিনসমূহে অন্যান্য আমলের মাঝে যিকিরের এক বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। হাদিস শরিফে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর বর্ণনা করেন, রাসূলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন―এ দশ দিনে নেক আমল করার চেয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে অধিক প্রিয় ও মহান আর কোনো আমল নেই। তোমরা এ সময়ে তাহলীল [লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ] তাকবীর [আল্লাহু আকবার] তাহমীদ [আল-হামদুলিল্লাহ] বেশি করে আদায় কর। মুসনাদে আহমাদ: ১৩২।
পাঁচ. তাকবীর, তাহলীল ও তাহমীদ: এ দিনগুলোতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের মহত্ত্ব ঘোষণার উদ্দেশ্যে তাকবীর পাঠ করা সুন্নত। এ তাকবীর প্রকাশ্যে ও উচ্চস্বরে মসজিদ, বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট, বাজার-সহ সর্বত্র উচ্চ আওয়াজে পাঠ করা হবে। তবে মেয়েরা নিম্ন-স্বরে তাকবীর পাঠ করবে। তাকবিরে হলো―‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ।
সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা: ও আবু হুরাইরা রা: জিলহজ মাসের প্রথম দশকে বাজারে যেতেন ও তাকবীর পাঠ করতেন, লোকজনও তাদের অনুসরণ করে তাকবীর পাঠ করতেন। অর্থাৎ, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই দুই প্রিয় সাহাবি লোকজনকে তাকবীর পাঠের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন। সহিহ বুখারি
ছয়. আরাফার দিন রোজা রাখা: হজ পালনকারী ছাড়া অন্যদের জন্য আরাফার দিন রোজা রাখা। আবু কাতাদাহ রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আরাফার দিনের রোজা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন―আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী, ইহা পূর্ববর্তী এক বছর ও পরবর্তী এক বছররে গুনাহর কাফফারা হবে। সহিহ মুসলিম: ১১৬৩।
সাত. কোরবানির দিনের ফযিলত: এ দিনের একটি নাম হল ইয়াওমুল হজ্জিল আকবর বা শ্রেষ্ঠ হজের দিন। যে দিনে হাজীগণ তাদের পশু যবেহ করে হজকে পূর্ণ করেন। হাদিসে শরিফে এসেছে,
ইবনে উমর রা: বর্ণনা করেন―রাসূলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোরবানির দিন জিজ্ঞেস করলেন এটা কোনো দিন? সাহাবিগণ উত্তর দিলেন এটা ইয়াওমুন্নাহার বা কোরবানির দিন। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: এটা হল ইয়াওমুল হজ্জিল আকবর বা শ্রেষ্ঠ হজের দিন। আবু দাউদ: ১৯৪৫,।
অন্য হাদিসে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনে কুরত রা: বর্ণনা করেন, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন― আল্লাহর নিকট দিবসসমূহের মাঝে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন হল কোরবানির দিন, তারপর পরবর্তী তিনদিন। আবু দাউদ: ১৭৬৫।
আট: কোরবানি করা: কোরবানি বলা হয় ঈদুল আজহার দিনগুলোতে নির্দিষ্ট প্রকারের গৃহপালিত পশু আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের লক্ষে যবেহ করা। হাদিস শরিফে বিবৃত হয়েছে, বারা ইবনে আযিব রা: বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন―যে ঈদের সালাতের পর কোরবানির পশু যবেহ করল তার কোরবানি পরিপূর্ণ হল ও সে মুসলিমদের আদর্শ সঠিকভাবে পালন করল। সহিহ বুখারি: ৫৫৪৫, সহিহ মুসলিম: ১৯১৬।
অন্য হাদিসে এসেছে, আনাস ইবনে মালিক রা: বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে দুটি সাদা কালো বর্ণের দুম্বা কোরবানি করেছেন। তিনি বিসমিল্লাহ ও আল্লাহু আকবর বলেছেন। তিনি পা দিয়ে দুটো কাঁধের পাশ চেপে রাখেন। সহিহ বুখারি: ৫৬৬৫, সহিহ মুসলিম: ১৯৬৬।
নয়. নখ-চুল ইত্যাদি না কাটা : যারা কোরবানি করার ইচ্ছা করবে তাদের জন্য জিলহজ মাসের প্রথম থেকে কোরবানি করা পর্যন্ত নখ-চুল ইত্যাদি কাটা থেকে বিরত থাকা মুস্তাহাব। রাসূলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন―‘যখন জিলহজের প্রথম দশক শুরু হবে তখন তোমাদের মধ্যে যে কোরবানি করবে সে যেন তার চুল ও নখ না কাটে। ’ সহিহ মুসলিম : ১৯৭৭
এবং কুররবানি করতে অক্ষম ব্যক্তি ঈদের পর নখ-চুল ইত্যাদি কাটে তাহলে তিনিও পূর্ণ একটি কোরবানির সওয়াব পাবে। কথা। আবু দাউদ: ২৭৮৯। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের আমল করার তাওফিক দান করু।