হজরত সুমাইয়া (রা.) ছিলেন হজরত আম্মার বিন ইয়াসির (রা.)-এর মা। প্রথম ইসলাম গ্রহণের হিসাবে তিনি সপ্তম। তখন পরিস্থিতি এতটা ভয়ানক ও বিপদসংকুল ছিল যে, ইসলাম গ্রহণ মানে জেনেশুনে নিজের জন্য বিপদ টেনে আনা।
তিনি ছিলেন এক কৃতদাসী। তার ইসলাম গ্রহণে কাফের মুশরিকরা ফেটে পড়ে। তার ওপর চালাতে থাকে জুলুম-নির্যাতনের স্টিমরোলার। তাকে দ্বীন থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য তার গোত্র ও কুরাইশের লোকজন যৌথভাবে জুলুম-নির্যাতনসহ সব রকমের অপতৎপরতা চালিয়ে যায়। মক্কার উত্তপ্ত বালুকারাশির ওপর লোহার পোশাক পরিয়ে প্রচণ্ড রোদের মধ্যে তাকে দাঁড় করিয়ে রাখত। কিন্তু তাদের বিভৎস নির্যাতন এবং কোনো ষড়যন্ত্রই তাকে তাওহিদ ও ইমানের দাবি থেকে কিঞ্চিত পরিমাণও সরাতে পারেনি।
তিনি ছিলেন খুবই দুর্বল-শীর্ণকায় এক নারী। কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর সেই দুর্বল নারীই এসব মনিবরূপী আল্লাহর দুশমনদের মোকাবিলায় হয়ে ওঠেন দুঃসাহসী, অপ্রতিরোধ্য এক বীরাঙ্গনা। একদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাফেররা তাকে নানারকম দুঃখ-কষ্ট দেওয়ার পর ঘরে নিয়ে আসে। ইতোমধ্যে হাজির হয় আবু জেহেল। সে সুমাইয়া (রা.)-কে প্রচণ্ড রেগে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে থাকে।
একপর্যায় তার রাগ পরিণত হয় হিংস্র হায়েনার উন্মাদনায়। ধারালো বর্শা দিয়ে হজরত সুমাইয়া (রা.)-এর ওপর এমন জোরে আঘাত করে যে, তিনি সঙ্গে সঙ্গে শাহাদতবরণ করেন।
এসব পৈশাচিক জুলুমের পরও দ্বীনের ওপর অটল-অবিচল থেকে হজরত সুমাইয়া (রা.) কেয়ামত পর্যন্ত আগত তাবৎ নারীদের সামনে আদর্শ স্থাপন করে যান যে, নারীরাও জীবন দিতে জানে, কিন্তু ইমান দিতে জানে না। শাহাদতবরণ করতে পারে, কিন্তু মিথ্যার সামনে মাথানত করে না। হজরত সুমাইয়া (রা.) হলেন ইসলামের প্রথম শহিদ। তার আগে কেউ শাহাদতবরণ করেনি।
উম্মে শারিক দাওসিয়া
হজরত উম্মে শারিক দাওসিয়া (রা.) ছিলেন ইয়েমেনের দাওস গোত্রের বংশোদ্ভূত। তিনি ইসলাম গ্রহণের পর তার আত্মীয়স্বজন ও আশপাশের লোকজন তাকে কঠিন নির্যাতন শুরু করে। কখনো ভর দুপুরে উত্তপ্ত রোদে তাকে দাঁড় করিয়ে রাখত। পিপাসায় গলা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হলেও পানি দিত না। একবার ৩ দিন পর্যন্ত তাকে পানি স্পর্শ করতে দেয়নি। তিনি এসব দুঃখ-কষ্ট নিভৃতে-নীরবে শুধু আল্লাহর জন্য সয়ে যান। কিন্তু ইমানের দাবি থেকে তিল পরিমাণও দূরে সরেননি। তার ওপর ক্রমাগত নির্যাতন নিপীড়ন করতে করতে এক সময় কাফের আত্মীয়স্বজনরাও অসহ্য হয়ে তাকে তার অবস্থার ওপর ছেড়ে দেয়।
জুনাইরা রুমিয়্যা
হজরত জুনাইরা রুমিয়্যা (রা.) ছিলেন বনু মাখজুমের দাসী। ইসলাম গ্রহণের পর কাফের মুশরিকরা তাকে নির্যাতনের নতুন ক্ষেত্র হিসাবে বেছে নেয়। একবার আবু জেহেল তাকে এত বেশি মারধর করে যে, তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তার এ অবস্থা দেখে মুশরিকরা বলে লাত-মানাত (কাফেরদের প্রধানতম দুটি মূর্তির নাম) তোমার দৃষ্টিশক্তি নিয়ে গেছে। হজরত জুনাইরা কাফেরদের কথায় লাফিয়ে ওঠেন, সেজদায় মাথানত করে আল্লাহর কাছে মিনতি জানিয়ে বলেন, হে আল্লাহ! লাত-মানাত তো পাথরের তৈরি মূর্তি। তারা তো জানেও না, কে তাদের পূজা করছে? তুমি তো শোনো ও দেখ, আমার কোনো অস্তিত্ব ছিল না, তুমি অস্তিত্ব দিয়েছ। তুমি দৃষ্টিশক্তি দিয়েছ, তুমিই নিয়ে নিয়েছ। আবার তুমি চাইলে দিয়েও দিতে পার। হে মাবুদ! তুমি আমাকে মুশরিক-বেইমানদের সামনে অপমানিত করো না। এ দোয়া করে হজরত জুনাইরা (রা.) ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই আল্লাহতায়ালা তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন। আল্লামা ইবনে হিশাম (র.) লিখেন, হজরত আবু বকর (রা.) তাকে ক্রয় করে স্বাধীন করে দেন।
উম্মে খুলাদ আনসারি
হজরত উম্মে খুলাদ আনসারি (রা.)-এর বিয়ে হয় সুওয়াইদ বিন সা’লাবা খাজরাজির সঙ্গে। সুওয়াইদ-এর ঔরসে জন্মগ্রহণ করে খুলাদ। হজরত খুলাদ বড় হয়ে দেশখ্যাত এক বীর হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। বনি কুরাইজার যুদ্ধে তিনি হুজুর (সা.)-এর দেহরক্ষী ছিলেন। এক ইহুদি নারী ঘরের ছাদ থেকে তার মাথার ওপর পাথর নিক্ষেপ করলে তিনি শাহাদতবরণ করেন। তার মৃত্যু সংবাদের সত্যতা যাচাই করতে মা উম্মে খুলাদ পর্দাবৃত হয়ে নবিয়ে কারিম (সা.)-এর কাছে আসেন।
উপস্থিত কেউ তাকে বলেন, তোমার ছেলে শাহাদতবরণ করেছে। আশ্চর্য! তুমি এমন বিপদের খবর পেয়েও চেহারা পর্দায় ঢেকে রেখেছ কেন? উত্তরে উম্মে খুলাদ (রা.) বলেন, আমি আমার ছেলে হারিয়েছি বলে লাজ-শরমও কি হারিয়ে ফেলব? সুনানে আবু দাউদে আছে, তখন রাসূল (সা.) বলেন, তোমার ছেলে দ্বিগুণ সওয়াব পাবে। যেহেতু সে আহলে কিতাবিদের হাতে শহিদ হয়েছে।
উম্মে হানি বিনতে আবু তালেব
হজরত উম্মে হানি বিনতে আবু তালেব (রা.) আলী (রা.)-এর নিকটাত্মীয় ছিলেন। মক্কা বিজয়ের দিন তার ঘরে আশ্রয় গ্রহণকারীদের নবিয়ে কারিম (সা.) নিরাপদ বলে ঘোষণা দেন। একবার নবিজি তার বাড়িতে বেড়াতে গেলে তিনি তাকে এক গ্লাস শরবত পান করান। নবিজি শরবত পান করার পর গ্লাসের নিচে একটু রেখে দেন। উম্মে হানি গ্লাসের অবশিষ্ট শরবতটুকু পান করেন এবং আবেদন করেন, হে আল্লাহর নবি! আমি রোজা ছিলাম, কিন্তু আপনার পান করার পর গ্লাসে থাকা অতিরিক্ত শরবতটুকু পান করে নিয়েছি। এখন শরিয়তের বিধান কী? নবি কারিম (সা.) বলেন, এটা যদি নফল রোজা হয়, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। এ ঘটনা থেকে সহজে অনুমান করা যায় যে, রাসূলে কারিম (সা.)-এর প্রতি তার কিরূপ ভালোবাসা ছিল।
উম্মে কুলসুম বিনতে উকবা
হজরত উম্মে কুলসুম বিনতে উকবা (রা.) অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে ইসলাম গ্রহণ করেন। ফলে দীর্ঘদিন পর্যন্ত তাকে নিজের ইমান গোপন রাখতে হয়। রাসূল (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর তিনি মদিনায় যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েন। তিনি ছিলেন পরিবারের অতি আদরের। তাই তার প্রতি সব সময় পিতা ও ভাইয়ের বিশেষ নজরদারি ছিল। অনেক দিন পর্যন্ত হিজরতের কোনো সুযোগ পাননি তিনি।
বদর যুদ্ধে যখন তার পিতা উতবা বিন আবি মাসিত মুসলমানদের হাতে মৃত্যুবরণ করেন তখন তার ভাই রাসূল (সা.) কে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে থাকে। ভাইয়ের এসব কথা শুনে উম্মে কুলসুম (রা.)-এর মন ভেঙে চৌচির হয়ে যেত। একে তো নারী, অপরদিকে সাধ্যের বাইরে তাই ভাইয়ের কথার প্রতিবাদ করতে পারতেন না। ধৈর্য ধরতেন আর আল্লাহর দরবারে দোয়া করতেন। যেন এ নোংরা পরিবেশ থেকে মুক্ত হতে পারেন। হুদাইবিয়ার সন্ধির কয়েক মাস পর ঘর থেকে বের হওয়ার সুযোগ পেয়ে তিনি বনি খুজাআর এক বিশ্বস্ত লোকের সঙ্গে হেঁটে মক্কা থেকে মদিনায় চলে যান। তার মদিনায় আসার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তার দুই ভাই ওয়ালিদ এবং আম্মার ছুটে আসেন মদিনায়।
নবিজিকে বলেন, হুদাইবিয়ার সন্ধি অনুযায়ী আমাদের বোনকে আমাদের কাছে সোপর্দ করুন।
সন্ধিতে মহিলাদের সম্পর্কে কোনো কথা লেখা ছিল না, তাই আল্লাহতায়ালা তখনই আয়াত নাজিল করলেন-‘আপনি যদি তাদেরকে মুমিন নারী মনে করেন তাহলে তাদেরকে কাফেরদের হাতে ফেরত দিবেন না।’ আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে রাসূলে কারিম (সা.) তাকে ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানালেন এবং তার ইজ্জত সম্মান রক্ষার্থে তাকে হজরত যায়েদ বিন হারেসা (রা.)-এর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলেন।