প্রতারণার নেশায় পেয়ে বসে তাকে। সে জন্যই হয়তো তিনি ব্যাংকের নিরাপদ চাকরি ছেড়ে দিয়ে এই কাতারে নাম ওঠান। আহসানুল আজিম রাজীব এখন পেশাদার প্রতারক। সমাজের চোখে এক ভয়ংকর দুর্বৃত্ত। তিনি একা নন, এ কাজে তার সঙ্গী করেছেন স্ত্রীকেও। তারা প্রতারণায় নামার আগে গবেষণা করে দেখেছেন কোন কায়দায় কোন শ্রেণির মানুষকে বোকা বানিয়ে ঠকানো যায়। তারা সেই পথটিও পেয়ে যান।
জিডিটাল বাংলাদেশের সঙ্গে বিজনেস প্লাস যুক্ত করে দিয়ে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের ফাঁদ তৈরি করেন। আর সেই ফাঁদে পা রেখে হাজার হাজার চাকরি প্রার্থী ও বেকার তরুণ-তরুণী নিঃস্ব হয়েছেন। তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া অর্থে ফুলেফেঁপে বড়লোক হয় রাজীব দম্পতি। তথ্য বলছে, রাজীবের গড়া রাজশাহীর ডিজিটাল বিজনেস প্লাস লিমিটেড নামের একটি প্রতারক প্রতিষ্ঠান আড়াই হাজার তরুণ-তরুণী ও চাকরি প্রার্থীর কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় ৩৯ কোটি টাকা।
চাকরির প্রলোভন ছাড়াও বিনিয়োগে দ্বিগুণ মুনাফার লোভ দেখিয়ে এ অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির আওতায় পাঁচটি প্রকল্পকে সাইনবোর্ড হিসাবে ব্যবহার করা হয়। আর এই বিপুল পরিমাণ টাকা দিয়ে একটি পাঁচতলা এবং একটি চারতলা ভবন নির্মাণ করেন প্রতিষ্ঠানটির মালিক মো. আহসানুল আজিম রাজীব (৪৪)। ১ কোটি ২০ লাখ টাকা দিয়ে কেনেন জমি। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
সিআইডি জানায়, ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠানটি চালুর পর থেকে রাজশাহী অঞ্চলের বহু মানুষ এতে বিনিয়োগ করতে থাকেন। বিভিন্ন মেয়াদে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ অর্থ দেওয়ার কথা বলে সাধারণ মানুষের থেকে অর্থগুলো নেওয়া হয়। কিন্তু কয়েক বছর অতিবাহিত হলেও জামানত ও মুনাফা ফেরত পাচ্ছিলেন না তারা। এরপর এ ঘটনায় রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আরএমপি) রাজপাড়া থানায় ২০১৩ সালের ১০ এপ্রিল একটি মামলা হয়। বৃহস্পতিবার রাজশাহীর আদালতে অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান। এতে মো. আহসানুল আজিম রাজীব ও তার সাবেক স্ত্রী জিন্নাত ফাতেমাকে (৩৮) আসামি করা হয়। আদালতের আদেশে রাজীব দম্পতির ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ এবং স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করা হয়।
সিআইডির অনুসন্ধানে রাজশাহী ডিজিটাল বিজনেস প্লাস লিমিটেড নামীয় প্রতিষ্ঠানসহ নিজ নামীয় ৩০টি ব্যাংক হিসাবে ৩৯ কোটি ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা জমা করার তথ্য উঠে আসে। এরমধ্যে ৩৮ কোটি ৯৪ লাখ ২০ হাজার টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করে রাজীব দম্পতি। এছাড়া বিলশিমলা মৌজায় আনুমানিক ৫ কাঠা জমির ওপর ৫ তলা ভবন (আনুমানিক মূল্য আড়াই কোটি টাকা), রাজশাহীতে আনুমানিক ১৭-২০ কাঠা জমির ওপর ৪ তলা ভবনসহ (আনুমানিক মূল্য এক কোটি টাকা) আনুমানিক ১৭ শতক জমি ক্রয় করে (আনুমানিক মূল্য ১ কোটি ২০ লাখ টাকা) রয়েছে তার। এগুলো প্রতারণার টাকায় গড়া।
যেভাবে প্রতারণা : রাজশাহী ডিজিটাল বিজনেস প্লাস লিমিটেড মানুষের মৌলিক চাহিদার আলোকে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও কর্মসংস্থান বিষয়ক ৫টি প্রকল্প গ্রহণ করে। এগুলো হলো-শিক্ষা সহায়ক প্রকল্প; ডিপার্টমেন্টাল স্টোর পরিচালনা, উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ প্রকল্প; বুটিক পরিচালনা পোশাক তৈরি প্রকল্প, আবাসন এবং চিকিৎসা প্রকল্প। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে শিক্ষা সহায়ক প্রকল্পের অধীনে রাজশাহী উপশহর এলাকায় রাজশাহী ডিজিটাল প্লাস মডেল স্কুল নামে ১ম শ্রেণি হতে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত স্কুল প্রতিষ্ঠার কিছুদিন পরেই বন্ধ করে দেয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদনবিহীন মহানগরীর বর্ণালীর মোড়, কাদিরগঞ্জ এলাকায় চিকিৎসা প্রকল্পের অধীনে ২০১২ সালের অক্টোবর থেকে রাজশাহী ডিজিটাল প্লাস মডেল হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু করে। এটাও কিছুদিন পরেই বন্ধ করে দেয়। এছাড়া ডিপার্টমেন্টাল স্টোর পরিচালনা, উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ প্রকল্পের আওতায় নগরীর বর্ণালীর মোড়ে মরিয়ম টাওয়ারের একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর চালু করে। সেখানে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে বুটিক ও তৈরি পোশাক বিক্রয়ের কার্যক্রমের আড়ালে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে অবৈধভাবে টাকা হাতিয়ে নেয়। এছাড়া চাকরি দেওয়ার নাম করে বিভিন্নজনের কাছে বড় অঙ্কের জামানত নেয়। ওই জামানত ফেরত না দিয়ে অনেককে চাকরি থেকে অব্যাহতি প্রদান করে। অনেক সময় প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। এভাবেই অনেকেই জীবনের সব সঞ্চয় তাদের হাতে তুলে দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন।
সিআইডির অরগানাইজড ক্রাইমের (ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম) পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, আসামিরা বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান ও সাধারণ জনসাধারণকে অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে ৩৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও জালিয়াতি করেছে। যা মানি লন্ডারিং আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ মামলায় মো. আহসানুল আজিম রাজীব, তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এমন অভিনব প্রতারক সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। তাদের কোনো প্রলোভনে না জেনে পা দিলেই সর্বনাশ হয়ে যাবে। সিআইডির একজন ডিআইজি বলেন, আমাদের কাছে এ ধরনের অসংখ্য কেস আসে। মানুষকে বোকা বানিয়ে একাধিক সংঘবদ্ধ চক্র লাফিয়ে লাফিয়ে বড়লোক হচ্ছে। আমরা না বুঝেই যেন তাদের কোনো ফাঁদে পা না দিই সেদিকে নজর রাখতে হবে।
যুগান্তরের প্রতিবেদন…