রুহুল আমিন,ডিমলা(নীলফামারী)
উত্তরাঞ্চলের কোটি মানুষের জীবন-জীবিকার অবলম্বন তিস্তা নদী আজ মৃত্যুশয্যায়। এই ভয়াবহ সংকট নিরসনে দ্রুত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে নীলফামারীর সীমান্ত উপজেলা ডিমলায় অনুষ্ঠিত হয়েছে এক বিশাল গণসমাবেশ।
বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) সকালে নীলফামারী জেলা বিএনপির উদ্যোগে এবং “জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাও” আন্দোলন কমিটি’র আহ্বানে ডিমলা উপজেলা বিএনপির কার্যালয় থেকে গণসমাবেশটি শুরু হয়। মুহূর্তেই তা জনস্রোতে পরিণত হয়।
কৃষক থেকে শিক্ষক, শিক্ষার্থী থেকে শ্রমজীবী- সব শ্রেণি-পেশার শত শত মানুষ ব্যানার ও ফেস্টুন হাতে অংশ নেন এই কর্মসূচিতে। উপজেলার প্রধান সড়কজুড়ে একটাই ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল- “তিস্তা বাঁচলে উত্তরবঙ্গ বাঁচবে”, “তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন চাই”, “ভাঙন রুখো, নদী খনন করো”।
গণসমাবেশে বক্তারা ক্ষোভের সঙ্গে তুলে ধরেন তিস্তার বর্তমান ভয়াবহ চিত্র। তাদের অভিযোগ, তিস্তার মূল সংকটের মূলে রয়েছে ভারতের গজলডোবা ব্যারাজ। বর্ষাকালে ভারত একতরফাভাবে ব্যারাজের গেট খুলে অতিরিক্ত পানি ছাড়ে, ফলে নীলফামারী, জলঢাকা, কাউনিয়া ও রংপুর অঞ্চলে আকস্মিক বন্যা দেখা দেয়। আবার শুষ্ক মৌসুমে গেট বন্ধ রাখায় তিস্তা শীর্ণ খালে পরিণত হয়। এতে কৃষি সেচ ব্যাহত হয়, নদীর তলদেশে বালুচর তৈরি হয় এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখে পড়ে।
এক বক্তা গজলডোবা ব্যারাজকে “উত্তরবঙ্গের জন্য অভিশাপ” আখ্যা দিয়ে বলেন, “বর্ষায় তারা গেট খুলে আমাদের ডুবিয়ে দেয়, আর শুষ্ক মৌসুমে গেট বন্ধ করে আমাদের ফসল নষ্ট করে। আমাদের অস্তিত্ব আজ সম্পূর্ণভাবে ভারতের হাতে জিম্মি।”
বক্তারা আরও অভিযোগ করেন, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে একাধিকবার আলোচনা হলেও ভারত এখনো কার্যকর কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি। এর ফলে উত্তরবঙ্গের মানুষ প্রতি বছর চরম অনিশ্চয়তা ও ভয়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।
গণসমাবেশে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, জেলা ও উপজেলা নেতৃবৃন্দ তিস্তা মহাপরিকল্পনাকে জাতীয় অগ্রাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানান।
নীলফামারী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য অধ্যাপিকা সেতারা সুলতানা বলেন, “তিস্তা মহাপরিকল্পনা কেবল একটি নদী ব্যবস্থাপনা প্রকল্প নয়, এটি কোটি মানুষের জীবিকার নিরাপত্তা। আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই- এই প্রকল্পকে জাতীয় অগ্রাধিকার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে দ্রুত বাস্তবায়ন করুন। তিস্তা বাঁচলে কৃষক বাঁচবে, নদীভাঙন থামবে, পর্যটন ও কৃষিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।”
‘তিস্তা বাঁচাও আন্দোলন কমিটি’র সদস্য ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ মনোয়ার হোসেন বলেন, “তিস্তার এই করুণ দশা আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বুঝতে হবে- এটি কোনো আঞ্চলিক বা রাজনৈতিক বিষয় নয়, এটি জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন। সরকার দ্রুত অর্থায়ন নিশ্চিত করে প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করুক।”
জেলা আহ্বায়ক কমিটির সদস্য গোলাম রব্বানী প্রধান বলেন, “তিস্তার সমস্যা নিরসনে দলমত নির্বিশেষে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে একসাথে চাপ সৃষ্টি করতে পারলেই তিস্তার ন্যায্য হিস্যা আদায় সম্ভব। মহাপরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত হবে।”
নদী বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রায় ৪১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তার ১২৪ কিলোমিটার অংশ বাংলাদেশে প্রবাহিত হলেও অনিয়মিত পানি ব্যবস্থাপনার কারণে নদীটি এখন ঋতুভিত্তিক মরুভূমি ও বর্ষাকালীন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। গজলডোবা ব্যারাজই নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে।
২০২৩ সালের জুলাইয়ে ভারত আকস্মিকভাবে গজলডোবার সব গেট খুলে দিলে বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। আবার ডিসেম্বর মাসে একই গেট বন্ধ রাখায় নদী শুকিয়ে যায়, কৃষিজমি অনুর্বর হয়ে পড়ে এবং হাজারো পরিবার ফসল হারায়। এই অনিয়মিত পানি ব্যবস্থাপনাই তিস্তার সংকটের মূল কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তাবিত “তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন প্রকল্প” বা তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে নদী পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণ ফিরে আসবে। প্রায় ৯,৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ের এই মহাপরিকল্পনায় নদী খনন, তীরসংরক্ষণ, আধুনিক সেচব্যবস্থা, জলাধার নির্মাণ, নৌপথ ও নদীভিত্তিক পর্যটন উন্নয়নের পরিকল্পনা রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সরাসরি উপকৃত হবেন অন্তত ২১ লাখ মানুষ।
গণসমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা ঘোষণা দেন- “তিস্তা বাঁচাতে আমরা ঐক্যবদ্ধ। ভারতের একতরফা পানি খেলা বন্ধ করতে হবে এবং সরকারকে এখনই তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।”
তারা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, “তিস্তা বাঁচলে কৃষি, অর্থনীতি ও মানুষ- সবই বাঁচবে। তিস্তা মরলে উত্তরবঙ্গও মরবে।”
তিস্তা এখন কেবল একটি নদী নয়, এটি উত্তরবঙ্গের প্রাণ- যার অস্তিত্ব রক্ষায় তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
