আরিফ শেখ, রংপুর
রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায় কর্মরত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকার নির্ধারিত সময়ে অফিস করছেন না। এমন অভিযোগ অনেক দিনের। অনেকে আবার নির্ধারিত সময়ের আগেই অফিস ত্যাগ করছেন। দেশ প্রেম আর দায়িত্ববোধ না থাকাকে দায়ী করছেন উপজেলার সেবা গ্রহীতারা।
সরেজমিনে তারাগঞ্জ উপজেলা পরিষদের মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনে গিয়ে দেখা যায় , ইকরচালী গ্রামের গৃহবধূ মৌসুমী আক্তার পায়চারি করছেন আর জানালা দিয়ে কর্মকর্তার কক্ষে উঁকি মারছেন । জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ম্যাডামের সাথে দেখা করার জন্যে সকাল সাড়ে ৯টায় উপজেলাত আলচি। কিন্তু ১১টা বাজে এখনো ম্যাডাম আইসে নাই। এটা ফির কেমন অফিস কন? ১১টায়ও অফিসার আইসে না। অফিসের লোক কওছে ম্যাডাম অ্যালাও রংপুরোত আছে। ওই জন্যে বাড়ি ফিরি যাওছি।’
বেলা ১১টা ১৮ মিনিটে মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নুরেশ কাওসার জাহানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘রাস্তায় আছি। কিছুক্ষণের মধ্যে অফিসে চলে আসব।’
দেরিতে আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একটা স্কুল পরিদর্শন করে অফিসে যাব।’
অন্যদিকে উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা কার্যালয়ের সামনে কথা হয় সেবাগ্রহীতা উপজেলার ফকিরপাড়া গ্রামের রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বেলা ১১টা বাজে এখনো কর্মকর্তার অফিসে আসার কোনো খবর নেই। এক ঘণ্টা ধরে অপেক্ষায় আছি। তিনি কখন আসবেন এ অফিসের কেউ বলতে পারেন না। একজন কর্মকর্তার সময় জ্ঞান না থাকলে আমরা সেবা পাব কীভাবে।’
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য একাধিকবার সমবায় কর্মকর্তা শারমিন আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মোবাইল ফোন রিসিভ করেননি।
দুপুর ১২টা পর্যন্ত বন কর্মকর্তা আকতারুজ্জামান খানের কার্যালয়ে তালা ঝুলতে দেখা গেছে। সরকারি বিধি অনুযায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সকাল ৯টা থেকে ৯টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত অফিসে উপস্থিত হয়ে অফিসের কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। এরপর মাঠের কাজে যাবেন। কিন্তু রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার অধিকাংশ কর্মকর্তাই তা মানছেন না।
সেবাগ্রহীতাদের অভিযোগ, নানা অজুহাতে অফিস ফাঁকি ও সঠিক সময়ে উপস্থিত না থাকাই এখন কিছু কর্মকর্তার নিয়ম হয়ে উঠেছে। অনেকেই ১১টা থেকে ১২টার পর অফিসে আসেন।
অভিযোগ রয়েছে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার তাঁর ইচ্ছে মতো অফিস করেন। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় তাঁর কার্যালয়ে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। অন্য কর্মকর্তাদের কক্ষগুলো ফাঁকা ছিল।
শিক্ষা কর্মকর্তা অফিসে এসেছেন কি না জানতে চাইলে অফিস সহকারী সুলতান হোসেন বলেন, ‘স্যার এখনো অফিসে আসেননি। রংপুর থেকে সরাসরি বিদ্যালয় পরিদর্শন করে অফিসে আসবেন। অন্য স্যারেরা মাঠে আছেন।’
১০টা ৫২ মিনিটে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আঞ্জুমান আরা বেগম বলেন, ‘রংপুরে থেকে তারাগঞ্জে যাচ্ছি, রোডে আছি। একটা স্কুল পরিদর্শন করে অফিসে যাব। অফিসে আমাকে ১২টার পর পাবেন।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষা অফিসের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর লেখাপড়ার বেহাল দশা। বেহাল দশা হবেই না কেন, যেখানে একজন শিক্ষা কর্মকর্তাই নিয়মিত, সময়মতো অফিস করেন না সেখানে তাঁর অধীনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কি করে, বোঝেন।’
খাদ্য নিয়ন্ত্রক রইচ উদ্দিনকে দুপুর ১২টা পর্যন্তও পাওয়া যায়নি। এ কর্মকর্তা কোথায় আছেন জানতে চাইলে অফিসে থাকা ফুড ইন্সপেক্টর সাবিনা ইয়াছমিন বলেন, ‘স্যার রংপুরে আছে। এখনো অফিসে আসেনি।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রায় রইচ উদ্দিন ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে অফিসে আসেন।’
বেলা দেড়টায় মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে খাদ্য নিয়ন্ত্রক রইচ উদ্দিন বলেন, ‘জেলায় একটি জুম মিটিংয়ে ছিলাম। এ কারণে দেরি হয়েছে। ১০ মিনিট আগে অফিসে এসেছি। ১১টার পর অফিস আসি এটা সত্য না।’
উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার নাজমুল হাসানের বিরুদ্ধে অভিযোগ সপ্তাহে দুই দিন অফিস করেন তিনি। আজ মঙ্গলবার দুপুর ১টা পর্যন্ত তাঁর কার্যালয়ে তালা ঝুলতে দেখা গেছে। এ বিষয়ে যোগযোগ করা হলে সাব রেজিস্ট্রার নাজমুল হাসান বলেন, ‘রংপুরে একটা মিটিংয়ে ছিলাম। আজকে তারাগঞ্জ যাব না। সপ্তাহে দুই দিন অফিস করি, এ অভিযোগ সত্যি না। কালকে অফিসে আসেন কথা হবে।’
এ ছাড়াও সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বন কর্মকর্তা আকতারুজ্জামান খান, উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার রাজশ্রী লাহা, সহকারী প্রোগ্রামার মাহাফুজা খাতুনের অফিসে তালা ঝুলতে দেখা যায়।
এ বিষয়ে কথা হলে তারাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুবেল রানা বলেন, ‘সকাল ৯টা থেকে ৯টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত কর্মকর্তাদের অফিসে থাকতে হবে। এখানে যোগদানের পর সব কর্মকর্তাকে বলেছি, গ্রুপেও লিখে দিয়েছি। এরপরও যদি কেউ সঠিক সময়ে অফিস না করে তাহলে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষে জানানো হবে।’