ন্যাটোয় যোগ দেওয়ার আর কোনও ইচ্ছে নেই ইউক্রেনের। দেশের দুই রুশপন্থী অঞ্চলকে ‘স্বাধীন’ করার সমঝোতাতেও তারা রাজি। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এ কথা জানাতেই বুধবার ক্রেমলিনের সুর কিছুটা নরম করল। এই প্রথম তাদের মুখে শোনা গেল, ইউক্রেন সরকারকে ‘গদিচ্যুত’ করার চেষ্টা করছে না রাশিয়া।
বরফ কি তবে গলছে? তিন দফায় শান্তি-বৈঠক করেছে ইউক্রেন ও রাশিয়া। এই প্রথম রাশিয়া জানাল, বৈঠকে বেশ কিছু সদর্থক ও ইতিবাচক উত্তর মিলেছে। ইউক্রেনের মুখেও ভিন্ন সুর। জ়েলেনস্কি বলেছেন, ‘ন্যাটোয় যোগ দেওয়ার প্রসঙ্গে আমি অনেক আগেই ঠান্ডা হয়ে গিয়েছি। যখনই বুঝেছি, ইউক্রেনকে দলে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত নয় ন্যাটো।
প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার ক্ষোভের অন্যতম কারণই হল, তাদের ন্যাটোতে যোগ দিতে চাওয়া। ঠান্ডা যুদ্ধের শুরুতে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের থেকে ইউরোপকে রক্ষা করতে তৈরি হয়েছিল এই ‘ট্রান্সআটলান্টিক’ গোষ্ঠী। রাশিয়া চায়নি একদা সোভিয়েতের অন্তর্ভুক্ত দেশ ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিক। তা ছাড়া ন্যাটোর এ ভাবে সামরিকবহরে আকার বৃদ্ধিও ভাল চোখে দেখছে না রাশিয়া। এর মধ্যে প্রতিবেশী ইউক্রেনের ন্যাটোয় যোগ দেওয়ার অর্থ রাশিয়ার দোরগোড়ায় তাদের সেনাবহরের উপস্থিতি। মস্কোর চোখে বিষয়টা ‘বিপজ্জনক’। এ নিয়ে শুরু থেকেই আপত্তি প্রকাশ করেছিল রাশিয়া। কিন্তু ইউক্রেন তা শোনেনি।
অন্য দিকে, ২০১৪ সাল থেকে কিয়েভের সঙ্গে ‘অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব’ চলছে পূর্ব ইউক্রেনের রুশপন্থী দুই অঞ্চল, ডোনেৎস্ক এবং লুগানস্কের। ইউক্রেন আক্রমণ করার ঠিক আগে এই দুই অঞ্চলকে ‘স্বাধীন প্রজাতন্ত্র’ ঘোষণা করেন পুতিন। তাঁর দাবি, এই দু’টি অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা দিতে হবে ইউক্রেনকেও। অর্থাৎ তাঁর ছোট্ট দেশটি ভেঙে আরও ছোট হবে। তাতে রাজি ছিলেন না জ়েলেনস্কি।
যদিও যুদ্ধের ১৪ দিন পরে, প্রায় ধ্বংসস্তূপের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নরম হতে বাধ্য হচ্ছেন। রাশিয়ার দাবির প্রসঙ্গে তিনি বুধবার বলেন, ‘কথা বলতে আমি রাজি। কিন্তু নিরাপত্তার নিশ্চয়তা থাকছে তো!’ জ়েলেনস্কির কথায়, ‘রাশিয়া ছাড়া আর কেউ এই দুই অঞ্চলকে প্রজাতান্ত্রিক দেশের মর্যাদা দেয়নি। কিন্তু আমি এ নিয়ে কথা বলতে রাজি। এই দুই অঞ্চলে মানুষ কী ভাবে বাঁচবে, সে নিয়ে সমঝোতা করতেও তৈরি। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হল, এই দুই অঞ্চলের বাসিন্দারা। এই অঞ্চলের কিছু মানুষ ইউক্রেনের সঙ্গে থাকতে চান, তাঁরা কী বলবেন। ইউক্রেনের মূল ভূখণ্ডের বাসিন্দারা এই অঞ্চলকে সঙ্গে নিয়ে থাকতে চাইতে পারেন। তাঁরা কী ভাবে বাঁচবেন! এদের নতুন পরিচিতকে শুধু মেনে নিলেই তো হল না, প্রশ্ন আরও জটিল।’
তিনি বলেন, ‘আমার আশা, শুধুমাত্র তথ্যের বুদবুদের ভিতরে আটকে না থেকে পুতিন এ বিষয়ে কথা বলা শুরু করবেন।’
রাজনৈতিক সমঝোতার পাশাপাশি যুদ্ধ নিয়েও সাময়িক মীমাংসায় পৌঁছেছে দুই দেশ। গতকাল সারাদিনের জন্য যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছিল রাশিয়া ও ইউক্রেন। তবে নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলের জন্য। ইউক্রেনের উপ-প্রধানমন্ত্রী ইরিনা ভেরেশচুক জানান, সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত যুদ্ধ বন্ধ রাখার বিষয়ে কথা দিয়েছে মস্কো। এই সময়ে যুদ্ধে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ছ’টি অঞ্চল (যার মধ্যে রয়েছে কিয়েভে, জাপোরিজিয়া ও উত্তরপূর্বের কিছু এলাকা) থেকে উদ্ধার করা হবে বাসিন্দাদের।
তবে মস্কোর মেজাজ নরম হলেও ইউক্রেনকে সাবধান থাকতে বলেছে ওয়াশিংটন। তাদের বক্তব্য, ওরা যাই বলুক, আগ্রাসন বন্ধ করবে না। আজ হয়েছেও তাই। মারিয়ুপোলের একটি শিশু ও প্রসূতি হাসপাতালে বোমা ফেলে রাশিয়া। শহরের কাউন্সিল একটি ভিডিয়ো পোস্ট করে জানিয়েছে, হাসপাতালের যে অংশে শিশুদের চিকিৎসা হয়, সেটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে রুশরা। হতাহত এখনও স্পষ্ট নয়। জ়েলেনস্কি সোশ্যাল মিডিয়ায় বলেন, ‘ধ্বংসস্তূপের তলায় চাপা পড়ে রয়েছে শিশুরা, মায়েরা। নৃশংস! আর কত দিন এই বিশ্ব চুপচাপ এই সন্ত্রাস দেখে যাবে?’
এ ঘটনার নিন্দা করে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেন, ‘দুর্বল, নিরস্ত্র, অসহায় মানুষকে নিশানা করার মতো আর কিছু হয় না।’ তাঁর কথায়, ‘এর জবাব পুতিনকেই দিতে হবে। আকাশপথে হামলা ঠেকাতে আমরা ইউক্রেনকে আরও সাহায্য পাঠাব।’
সরাসরি ইউক্রেনের পাশে এসে না দাঁড়ালেও রাশিয়ার উপরে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা বাড়িয়েই চলেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। রাশিয়ার ক্রিপ্টোকারেন্সি ট্রান্সফারেও নিয়ন্ত্রণ শুরু করেছে তারা। সমুদ্র ক্ষেত্রেও কড়াকড়ি জারি হয়েছে। এ বিষয়ে পশ্চিমের দেশগুলিকে সর্তক করে দিয়ে রাশিয়া আজ জানিয়েছে, এর বড়সড় জবাব দিতে তৈরি হচ্ছে তারা। রুশ বিদেশ মন্ত্রকের অর্থনৈতিক সহযোগিতা দফতরের প্রধান দিমিত্রি বিরিচেভস্কি-র কথায়, ‘আমাদের প্রতিক্রিয়ার জোরদার ঝটকা হবে, যার প্রভাব ভাল মতো টের পাবে ওদের স্পর্শকারত এলাকাগুলো।’’
ইউরোপকে ফের যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠতে দেখে ‘মর্মাহত’চীন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ ও জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলৎজ়ের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠকে চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেন, ‘শান্তি আলোচনার মাধ্যমে রাশিয়া ও ইউক্রেনের দ্বন্দ্ব মেটানোর বিষয়ে জোর দেওয়া উচিত আমাদের।’ তবে এই সার্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতির জন্য যুক্তরাস্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটোকে দুষছে চীন। তাদের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বলেন, ন্যাটোর জন্যই ‘বাঁধ ভেঙেছে’। রুশ আগ্রাসনের নিন্দা করতেও অস্বীকার করেছেন তিনি। বেজিংয়ের বক্তব্য, নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই এই কাজ করেছে মস্কো। রাশিয়ার এ ধরনের চিন্তা বৈধ। পশ্চিমের দেশগুলোর উচিত রুশ পরিসরকে গুরুত্ব ও সম্মান দিয়ে চলা। বিশেষ করে আমেরিকার জন্য তাদের পরামর্শ, মস্কোর বিষয়ে দূরত্ব বজায় রাখুক ওয়াশিংটন। চীনের মন্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রে গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র বক্তব্য, ‘ইউক্রেনের পরিস্থিতি দেখে প্রেসিডেন্ট শি ও তাঁর নেতৃত্ব আসলে একটু ঘাবড়ে গিয়েছেন। রাশিয়াকে যে এ ভাবে বিপাকে পড়তে হবে, তা হয়তো ওরা ভাবতে পারেনি।’