ববি প্রতিনিধি:
তামজিদ হোসেন মজুমদার বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) চলমান আন্দোলন উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আজও (৮ মে) বেলা ১১ টাই অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। পরবর্তীতে বেলা ১২ টার দিকে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের সাথে একাত্মতা পোষণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ আন্দোলনে যোগ দেন। শিক্ষক সমাজ তার বিবৃতিতে বলেন, আমরা, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা, ২০২৪ সালের গৌরবজনক জুলাই বিপ্লবের পরে বড় আশায় বুক বেঁধেছিলাম একটি নতুন বাংলাদেশের বিনির্মাণ কার্যক্রমের সাথে তাল রেখে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ও একটি শিক্ষার্থী ও শিক্ষক বান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে শনৈ শনৈ উন্নতির পথে অগ্রসর হবে।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে গত অক্টোবর ২০২৪ থেকে এযাবৎ আমরা লক্ষ্য করছি- ১। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক বিভাগে মাত্র দুজন/তিনজন শিক্ষক কর্মরত এবং সেগুলোসহ অনেক বিভাগে অনেক শূন্যপদে নিয়োগের বিজ্ঞাপন থাকা সত্ত্বেও এই আট মাসে সেই সকল বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় বিভাগসমূহের পাঠদান ও অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ছে। অথচ ভিসি মহোদয় এদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ না করে ঢাকায় নির্বিকার দিন যাপন করছেন। আরো মর্মান্তিক হলো তিনি শিক্ষক নিয়োগের এ সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো উদ্যোগ না নিয়ে বরং একের পর এক বেআইনি ও অবৈধভাবে নিম্ন গ্রেডের বিভিন্ন কর্মচারী পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে যাচ্ছেন।
এসকল নিয়োগ অবৈধ হওয়ায় তাদের বেতন-ভাতাদির প্রস্তাব সংক্রান্ত নথি ট্রেজারার মহোদয় অনুমোদন না করায় তাঁর অনুমোদন ছাড়াই ভিসি একক স্বাক্ষরে অনুমোদন করছেন এবং তাদেরকে অবৈধভাবে বেতন-ভাতাদি দিচ্ছেন। ২। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. শুচিতা শরমিনের নিয়োগপত্রে তাঁকে সার্বক্ষণিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে হবে মর্মে বলা হলেও তিনি সপ্তাহে দুয়েকদিন কয়েক ঘণ্টা মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করেন আর বাকি সময় ঢাকায় অবস্থান করেন। তাঁর এই অনুপস্থিতিতে আইনানুযায়ী উপ-উপাচার্যকে দায়িত্ব পালনের সুযোগও তিনি দেন না।
বিভাগ থেকে প্রেরিত ছাত্রদের পরীক্ষা-ভর্তি ইত্যাদি বিষয়ক বিভিন্ন অ্যাকাডেমিক প্রস্তাব তাঁর দপ্তরে তিন-চার মাস পড়ে থাকে এবং তিনি দেখারও সময় পান না। ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের এক ক্যান্সার আক্রান্ত শিক্ষার্থীর একটি সাহায্যের আবেদন ডিসেম্বর মাস থেকে এপ্রিল মাসে তার মৃত্যুর তারিখ পর্যন্ত ভিসির দপ্তরে পড়েছিল, অথচ তিনি খুলেও দেখেননি। এভাবে দাপ্তরিক কর্মকাণ্ডে মারাত্মক জট ও বিপর্যয় দিন দিন বেড়েই চলছে।
৩ ভিসির যোগদানের পর থেকে আট মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ কমিটির বা পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কমিটির কোনো একটি সভা এ যাবৎ অনুষ্ঠিত হয়নি। ভিসি দুটি সিন্ডিকেট সভা আয়োজন করেছেন যার একটি ছিল এজেন্ডা-গোপন-রাখা দুরভিসন্ধিমূলক সভা যা শিক্ষার্থীদের বাঁধার মুখে নিয়মহীনভাবে জরুরি একটিমাত্র আলোচ্য বিষয়ের বিশেষ সভায় রূপান্তর করা হয় এবং অপরটিও ছিল একটি বিশেষ সভা। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের অজস্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তের অভাবে মাসের পর মাস আটকে আছে যার প্রতি ভিসির কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।
আর সিন্ডিকেটে তাঁর স্বৈরাচারী ইচ্ছা মোতাবেক সিদ্ধান্ত গ্রহণের লক্ষ্যে তিনি আইন অনুযায়ী সিন্ডিকেটে যে কয়জন শিক্ষক প্রতিনিধি থাকার কথা তাঁদের সকলকে নিয়মহীনভাবে অপসারণ করেছেন। একই সাথে বিগত অনির্বাচিত স্বৈরাচারী সরকারকে বৈধতা দানের লক্ষ্যে গঠিত জানিপপের সুবিধাভোগী আর সেই জানিপপের কাণ্ডারি জনাব নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহর খয়ের খা চারজনকে বিশেষ ব্যবস্থায় সিন্ডিকেটের সদস্য করেছেন যাতে ভিসির সকল স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত অবলীলায় পাশ করা যায়।
৪। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভৌত কাজ ও ক্রয়ের জন্য ৬ কোটি ২ লক্ষ টাকা বরাদ্দ ছিল। ভিসির সীমাহীন অদক্ষতা ও অযোগ্যতার কারণে আজ বছরের প্রায় ১১ মাস অতিবাহিত হওয়ার পরেও তা থেকে মাত্র ৭৭ লক্ষ টাকা ব্যয় করা সম্ভব হয়েছে। বই কেনার ৫০ লক্ষ টাকা থেকে একটি বইও এখন পর্যন্ত ক্রয় করা হয়নি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে যথেষ্ট বাজেট বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও ভিসির অযোগ্যতার কারণে কোনো উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না।
৫। এ অবস্থায় ছাত্রদের অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক অনেক সংকট ও সমস্যা তৈরি হওয়ায় তারা এসব সমাধানে ভিসির নিকট দাবিনামা উপস্থাপন করলে ভিসি তাদের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে দাবি পূরণের ব্যবস্থা না নিয়ে একের পর এক মামলা, জিডি ইত্যাদি দিয়ে স্বৈরাচারী সরকারের মতো দমন পীড়নের পথ বেছে নিচ্ছেন। ভিসির এই ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ড বিশ্ববিদ্যালয়টিকে দিনদিন সম্পূর্ণ অচলাবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
৬। জুলাইয়ের গৌরবজনক অভ্যুত্থানের ফসল হিসেবে নিযুক্ত ভিসি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে খুঁজে খুঁজে স্বৈরাচারী সরকারকে রক্ষার প্রত্যয় ব্যক্তকারী শিক্ষক ও কর্মকর্তাদেরকে বিভিন্ন লাভজনক কমিটি ও প্রশাসনিক পদে নিয়োগ দিচ্ছেন। বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণার কমিটির বিভিন্ন সদস্যকে গুরুত্বপূর্ণ লাভজনক কমিটি ও পদে পদায়ন করেছেন। অপর দিকে গত ফ্যাসিবাদী সরকারের দীর্ঘ ক্ষমতাকালে আওয়ামী শিক্ষকদের পেশাজীবী সংগঠন ‘নীল’ দলে শত চাপের মধ্যেও কখনো যোগদান করেননি এবং বৈষম্যবিরোধী সংগ্রামের ছাত্রদের ওপর সরকারি নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়ে পত্রিকায় বিবৃতি প্রদান করেছেন এমন শিক্ষককে ‘পতিত সরকারের দোসর’ আখ্যা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেট থেকে বিধিবহির্ভূতভাবে অপসারণ করেছেন।
৭। আরো মর্মান্তিক বিষয় হলো ছাত্রদের দাবির সাথে মস্করা করে বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের দোসর চিহ্নিত করার নামে এই ভিসি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে একটি প্রহসনমূলক কমিটি করেছেন। প্রহসনমূলক এ কারণে যে, এক সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটির প্রধান হলেন সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একজন শিক্ষক যিনি নিজে বিগত সরকারের অবৈধ নির্বাচনকে বৈধতা দানের সংগঠন জানিপপের সিলেটের সংশ্লিষ্ট শাখার সহ-সমন্বয়ক ছিলেন।
৮। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষক অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ইত্যাদি পদে পদোন্নতির যোগ্য হয়ে প্রায় বছর পার করে ফেলছেন। অথচ, তাঁদের ন্যায্য পদোন্নতির কার্যক্রম বিষয়ে ভিসি কোনোরকম উদ্যোগ গ্রহণ না করে পুরো বিষয়টি অনির্দিষ্টভাবে ঝুলিয়ে রাখছেন যা শিক্ষকগণের মাঝে বঞ্চনাজনিত পেশাগত অসন্তোষ দিন দিন বৃদ্ধি করছে। সুষ্ঠু অ্যাকাডেমিক কার্যাদি সম্পাদনের ক্ষেত্রে এ অসন্তোষ একটি মারাত্মক বাঁধা। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির এই জাতীয় সকল স্বৈরাচারী ও অপেশাদার আচরণ, দুর্নীতিগ্রস্ততা এবং মারাত্মক অদক্ষতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টি দিনদিন চরম অধোগতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের দাবিনামার সাথে আমরা একাত্মতা পোষণ করছি এবং বিশ্ববিদ্যালয়টিকে এই অধোগতি ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য শিক্ষা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্রতি বিনীত আহ্বান জানাচ্ছি। বর্তমান আন্দোলনের অগ্রগতি সম্পর্কে চলমান আন্দোলনের অন্যতম শিক্ষার্থী সজয় শুভ বলেন,” আপনারা ইতি মধ্যেই দেখেছেন, চলমান আন্দোলনের সাথে শিক্ষকরা ও সংহতি প্রকাশ করেছেন।
উপাচার্য পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আন্দোলন চলমান থাকবে। যেহেতু আগামীকাল গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা, সেহেতু আমাদের আগামীকাল প্রদান কর্মসূচি হচ্ছে উপাচার্যের অনুপস্থিত কীভাবে ভর্তি পরীক্ষা সফল করা যায়। তারও পরবর্তী কর্মসূচির সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন,যেহেতু অধিকাংশ ডিপার্টমেন্ট আমাদের আন্দোলন সাথে একাত্মতা পোষণ করেছেন, সেহেতু আমরা শিক্ষার্থীদের মতামতের উপর ভিত্তি করে বিশ্ববিদ্যালয় শাটডাউন কর্মসূচি দিতে পারি।