বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিবেদন
লুটেরা অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি উঠেছে। বিগত সরকারের অন্যতম ক্ষমতাধর মন্ত্রী অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের বিরুদ্ধে ভয়াবহ অর্থ পাচারের তথ্য পেয়েছে দুদক। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক লুট ও অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে এস আলমের বিরুদ্ধে। এদের দেশে ফিরিয়ে এনে লুট করা অর্থ উদ্ধার জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, যাঁরা ভাবেন, পাচার করা অর্থ ফেরত আনা যাবে না, তাঁরা ভুল করছেন। পাচারকারীদের ফেরত আনতে প্রয়োজনে ইন্টারপোলের সহায়তা নিতে হবে। পাচারের অর্থ ফেরত আনতে পারলে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে সহায়ক হবে।
দুর্নীতি দমন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম ও তাঁর সহযোগীরা সংঘবদ্ধ অপরাধ, প্রতারণা, জালিয়াতি ও হুন্ডি কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে ১ লাখ ১৩ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। সিঙ্গাপুরে নাগরিকত্ব নিয়েছেন। ক্ষমতাচ্যুৎ শেখ হাসিনা সরকারের ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী (জাবেদ) শুধু পাচারের অর্থে যুক্তরাজ্যেই ৩৬০টি বাড়ির মালিক। বাড়িগুলোর বর্তমান বাজারমূল্য ৩২ কোটি ডলার। বাংলাদেশি টাকায় এই অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮২৪ কোটি টাকার বেশি। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্র, লন্ডন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাচারের টাকায় গড়েছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কিনেছেন ফ্ল্যাট। দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে নিজের আখের গুছিয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ওরফে লোটাস কামাল ও তার মেয়ে নাফিসা কামাল। বাপ-মেয়ে ও তাদের পরিবারের সদস্যরা প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা পাচার করে দুবাইয়ে বিশাল সাম্রাজ্য গড়েছেন। দুদক সূত্র বলছে, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর নামে সরকার নির্ধারিত অতিরিক্ত ফি বাবদ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে লোটাস কামাল ও তার পরিবারিক চক্র।
এ বিষয়ে ট্রান্সপ্যারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এস আলম, সাইফুজ্জামান চৌধুরীসহ অর্থ পাচারকারীদের অবশ্যই ফেরত এনে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত এবং এটা সম্ভব। যেসব দেশে অর্থ পাচার করেছে, সেসব দেশের সঙ্গে আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতা চুক্তি করতে হবে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে প্রক্রিয়াটা দীর্ঘ। পাচারকারীরা বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার করে বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করেছেন। তাই সংশ্লিষ্ট দেশকে অবহিত করতে হবে যে, আপনার দেশে বিনিয়োগকৃত অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে এসেছে। বা অপরাধের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ আপনাদের দেশে লগ্নি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, যারা অর্থ পাচার করেছে তাদের দেশে ফেরত এনে শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে, দেশে থাকা সম্পদও বাজেয়াপ্ত করতে হবে। পাচারকারীরা কোন কোন দেশে অবস্থান করছে, সেটা চিহ্নিত করে আইন অনুযায়ী সে দেশের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে ফেরত আনতে হবে এবং আনা সম্ভব। পৃথিবীর যে দেশেই যাক না কেন প্রয়োজনে ইন্টারপোলের সহায়তায় চিহ্নিত করে তাদেরকে ফেরত আনতে হবে। এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পাচারের অর্থ ফেরত আনার পাশাপাশি পাচারকারীদেরকেও ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। এটা নিশ্চিত করতে না পারলে ভবিষ্যতে অর্থ পাচার ঠেকানো কঠিন হবে। তাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী অর্থ পাচারকারীদের চিহ্নিত করে ফেরত আনতে হবে এবং অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইনে বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেছেন, শুধু পাচারের অর্থ ফেরত আনলেই হবে না। পাচারকারীদের বিরুদ্ধে দেশে যে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সেগুলোর রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করে তারা যেসব দেশে আছে তাদের অবগত করে দেশে ফিরিয়ে এনে আইনের মুখোমুখি করতে হবে। কারণ অর্থ আত্মসাৎ এবং রাষ্ট্রীয় অর্থ বিদেশে পাচার করা দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করার মতো অপরাধীদের যদি আইনের মুখোমুখি করা না হয়, তাহলে এস আলম, সাইফুজ্জামান চৌধুরী, আ হ ম মুস্তফা কামালের মতো লোকেরা ভবিষ্যতে অর্থ পাচারে তোয়াক্কা করবেন না। মনে করবেন বা করেছেন ক্ষমতা থাকলেই অর্থ আত্মসাৎ এবং পাচার তারা করতে পারেন। এটা যে সম্ভব নয়, সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। সেই দৃষ্টান্ত স্থাপনের প্রশ্নেই এদের ফিরিয়ে আনা দরকার। পাশাপাশি তাদের অর্থও ফিরিয়ে এনে জনস্বার্থে ব্যবহার করা উচিত।