তিমির বনিক,মৌলভীবাজার প্রতিনিধি:
মৌলভীবাজারে জুড়ীতে ছোটবড় আকাঁবাকাঁ পাহাড়ি টিলায় স্থানীয় বসতিরা গড়ে তুলেছেন কমলা বাগান। বাগানগুলো থেকে হেমন্তের বাতাসে ছড়াচ্ছে কমলার সুস্বাদু মিষ্টি ঘ্রান। বাগানের ছোটবড় গাছে গাছে দোল খাচ্ছে পাকাঁ ও আদাপাকাঁ কমলালেবু। কমলার সঙ্গে সঙ্গে গাছের ডালে ডালে উড়ে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন ধরণের উপকারি ও অপকারি পোকার দল। প্রকৃতির অপরূপ এ সৌন্দর্যে কৃষকের বুকে যেন অপার আনন্দ। তবে চাষিদের এবারে আনন্দের মাত্রা অনেকটা কমে গেছে। কারণ অন্য বছরের তুলনায় এ বছর খড়া বেশি ছিল। সময়মত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ও সেঁচের পানির অভাবে খড়ায় ঝরছে ফুল ও ফল। এছাড়াও পাহাড়ি অঞ্চলের বাগানগুলোতে গান্ধি পোকার আক্রমণে পাকার আগেই ঝড়ে পড়ছে অসংখ্য ফল। যার কারণে ফলন ভালো হয়নি। তবে কিছু কিছু কৃষক পোকামাকড় নিধনে “সেক্সফরমুনফাঁক ও আলোক ফাঁদ” পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। এ পদ্ধতি ব্যবহার করে অন্যান্য পোকামাকড় দমন করা গেলেও গান্ধি পোকা দমন করা যায়নি। ফলে এবারে আশানুরূপ ফলন পাওয়া সম্ভব হবে না।
উপজেলার গোয়ালবাড়ি ইউনিয়েনের লালছড়া,শুকনাছড়া, ডোমাবাড়ি, লাঠিটিলা, লাঠিছড়া,হায়াছড়া,কচুরগুল। সাগরনাল ইউনিয়নের পুট্টিছড়া ও পূর্বজুড়ী ইউনিয়নের বিনোদপুর, দূর্গাপুর,জামকান্দি, ছোট ধামাই গ্রামে এবং জায়ফরনগর ইউনিয়নের বাহাদুরপুরসহ অন্যান্য গ্রামের টিলা বাড়িগুলোতে রয়েছে কমলা বাগান। আবহাওয়া অনুকুলে থাকলে ও সঠিকভাবে পরিচর্যায় এক একটি বাগান থেকে প্রতি বছর ৫ থেকে ৮ লাখ টাকার ফলন বাজারজাত করা সম্ভব হয়। দেশে লেবুজাতীয় ফসলের সংকট ও ভিটামিন (সি) মোকাবেলা করতে ও বিদেশ থেকে কমলা আমদানি রোধ করতে অর্থাৎ, কমলা উৎপাদনে দেশে স্থানীয় কৃষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে সঠিক নিয়ম পর্যবেক্ষণ করে উৎপাদনে বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করছে কৃষি সম্প্রারণ অধিদপ্তর।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ৯৬.৫ হেক্টর জমিতে প্রায় ৯৫টি কমলা বাগান রয়েছে। তন্মধ্যে গোয়ালবাড়ি ইউপিতে ৬২ হেক্টর। অত্রাঞ্চলের অধিকাংশ কমলা খাঁসি ও নাগপুরি জাতের আবাদ হচ্ছে। সম্প্রতি জুড়ীতে নতুন দুই জাত কমলা উদ্ভাবন করা হয়েছে বারি-১ ও বারি-৩ জাতের।
উপজেলার গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা রনি সিংহ ও পূর্বজুড়ী ইউনিয়নের উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা সুরঞ্জিত ধর রনি আলাপকালে বলেন, তুলনামূলক এ বছর কমলার ফলন কম হয়েছে। তবে এবারে কমলায় কিছুটা মাছি ও গান্ধিপোকার আক্রমণ রয়েছে। আমরা সব সময় কৃষকদের পাশে থেকে নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু চাষিরা যেভাবে কাজ করার কথা, সেভাবে কাজ করেনি। প্রতিবছর কমলার উৎপাদন ভালো হলেও শেষ পর্যন্ত কমলার মান খুব একটা ভালো হয় না। সেক্ষেত্রে কমলা গাছে জাল ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে কৃষকরা লাভের মুখ দেখার সম্ভাবনা রয়েছে। লেবু জাতীয় ফসলের সম্প্রসারণ, ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প নামক একটি প্রকল্প আসার পর থেকে কিছু সহযোগিতা করা হচ্ছে। গোয়ালবাড়ি ও পূর্বজুড়ী ইউনিয়নে তা সঠিক পরিচর্যা এবং কৃষকদের কার্যকরি পদক্ষেপ থাকলে পূর্বের স্থানে ফিরিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব।
লালছড়া গ্রামের কমলা চাষি জয়নুল মিয়া বলেন, বর্তমান সময়ে বাজারে দ্রব্যমূল্যের অনেক দাম। দ্রব্যমূল্যের বেশি দাম থাকায় জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেজন্য কমলা চাষের মতো পেশায় সময় দিয়ে এখন আগের মতো জীবিকা চলে না। তীব্র খরা ও বিষাক্ত পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা করা কঠিন। তিনি আরো বলেন, মৌসুমের প্রথমে তীব্র খরার কারণে এ বছর কমলার ফুল ঝড়ে গেছে। বিগত বছর গুলোর চেয়ে কমলার উৎপাদন কমে গেছে। ধীরে ধীরে পাতা হলুদ হয়ে বাগানের সব গাছ গুলো মারা যাচ্ছে। গাছ না বাঁচাতে পারলে কমলার আশা ছেড়ে দিতে হবে।
হায়াছড়া গ্রামের কমলা চাষি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আমার বাগানে প্রায় ২৫০ টি গাছ আছে। গত বছরে তুলনায় এবার আশানুরূপ ফলন ভালো হয়েছে। তবে গান্ধিপোকার আক্রমণে ফল ভালো ভাবে ঠিকিয়ে রাখতে পারছি না। ফল পাকার আগে ঝড়ে যাচ্ছে। সরকারি ভাবে আমরা ঔষধ পেয়েছি। কিন্তু এগুলো প্রয়োগে কোন কাজ হচ্ছে না।
লালছড়া গ্রামের কমলা চাষি মোর্শেদ মিয়ার ও জসিম উদ্দিন জানান, যখন কমলা গাছে ফুল আসে তখন কমলা গাছে পানির প্রয়োজন হয়। এবারে সময় মতো বৃষ্টি না হওয়ায় ও সেঁচ দিতে না পারার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কোন ভাবে সময় মতো সেঁচের ব্যবস্থা করতে পারলে বাম্পার ফলনের আশা ছিল। প্রতি বছর কমলা বিক্রি করে লক্ষাধিক টাকা লাভবান হলেও এবছর কামলা চাষে যা খরচ হয়েছে তাও উঠবে না। এছাড়াও অজ্ঞাত কারণে পাতা হলুদ হয়ে গাছ মারা যাচ্ছে।
গোয়ালবাড়ি ইউপির বিভিন্ন গ্রামে প্রতিবছর কমলা হারবেস্টিং করেন স্থানীয় আসুক মিয়া। তিনি বলেন, আমাদের এলাকায় ছোট বড় প্রায় শতাধিক কমলার বাগান রয়েছে। আমি প্রায় ৬ বছর ধরে কমলার মৌসুমে শ্রমিক হিসেবে কাজ করি। পাঁচ বছর আগে কমলার ফলন অনেক বেশি ছিল, এখন আগের মতো ফলন হয় না। দিন দিন কমেছে কমলার ফলন। আর অজ্ঞাত কারণে গাছও মারা যাচ্ছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদুল আলম খাঁন প্রতিবেদকে বলেন, কমলার ফুল আসার সময়ে খরা ছিল। টিলা বাগানে পানি সেঁচের ব্যবস্থা না থাকায় আমরা বোতলে ছিদ্র করে গাছের গোড়ায় রাখার পরামর্শ দিয়েছি। গোয়ালবাড়ী ও পূর্বজুড়ী ইউপির পাহাড়ি অঞ্চলে কমলার বাগানগুলোতে গান্ধি পোকার আক্রমণ রয়েছে। গান্ধীপোকা কন্ট্রোল করা কঠিন। চাষিরা যদি সঠিক সময়ে সঠিক ঔষধ ব্যবহার করতেন, তাহলে এবারে ও লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেত।