দলগতভাবে কতিপয় কিশোর যখন বিভিন্ন অপরাধ মূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পরে,তখন তাকে কিশোর গ্যাং বলে।পত্রিকা,অনলাইন নিউজ,মিডিয়ায় বিভিন্ন খবরে কিশোর গ্যাং কালচারের বিভিন্ন ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠছে।এসব খবর পড়লেই হৃদয়টা কেমন যেন ধুমড়ে-মুচড়ে উঠে।বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে অধিকাংশ কিশোর গ্যাং এর সদস্যদের বয়স ১৪ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে,আর এদের সদস্য থাকে প্রতি গ্রুপে ১০-১৫ জন।যে বয়সটায় নিজেকে একজন আদর্শ সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে টেবিলে বই,খাতা কলম নিয়ে অধ্যাবসায় নিয়ে পড়াশুনার কথা সেই বয়সটায়,অধিকাংশ কিশোর ঝড়ে পড়ছে।বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, দেশে ৫-১৭ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি,এদের মধ্যে ১ কোটি ৩০ লক্ষ শিশু,শিশু শ্রমের সাথে যুক্ত।জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল(UNFPA) এর তথ্য মতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়া বয়সী শিশুদের মধ্যে ৯৫% বিদ্যালয়ে যায়।কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য,মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যাওয়া উপযুক্ত বয়সীদের মধ্যে ৬২% বিদ্যালয়ে যায়।এসব শিক্ষার্থীদের ঝড়ে পড়ার কারণ কি?কিশোরীদের মধ্যে ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই ৫৯% কিশোরীর বিয়ে হয়ে যায়,আর কিশোররা বেপরোয়া হয়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পরে,ঝড়ে পড়ছে।কিশোর গ্যাং তৈরি হওয়ার পিছনের নৈপথ্যে কারা দায়ী?এর দায় পরিবার,সমাজ,শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান,রাষ্ট্র কেউ এড়াতে পারে না।নিম্ম বিত্ত পরিবারের মা-বাবারা তাদের সন্তানদের সময় দিতে পারে না,উভয়েই কাজ করে।আর মধ্যবিত্ত-উচ্চ বিত্তরা অধিক সম্পদ অর্জনের পিছনে ছুটে নিজেদের সন্তানদের সময় দেওয়ার ব্যর্থতা ডাকতে যখন যা চায় তাই দেয়।ফলশ্রুতিতে নিম্ন বিত্ত পরিবারের কিছু সন্তানেরা,উচ্চ বিক্ত পরিবারের কিছু সন্তানদের বেপরোয়া চলাফেরা,হাতে দামি ব্রান্ডের স্মার্টফোন, বাইক ইত্যাদি দেখে তারা হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে।আর উচ্চ বিত্ত পরিবারের কিছু সন্তানেরা,অপসংস্কৃতিতে নিমজ্জিত হয়ে মাদকাসক্ত হয়ে পরে।গ্রুপিং রাজনীতি,ক্ষমতার দাপট ইত্যাদি দেখাতে পড়াশোনা না করে বেপরোয়া হয়ে ওঠে।তাদের ধারণা হয়ে উঠে,পড়াশোনা করে কি হবে,অঢেল সম্পদতো রয়েছেই।আর এদের পিছনে থাকে তথাকথিত বিভিন্ন রাজনৈতিক সংঘঠনের কিছু বড় ভাই।অলিখিতভাবে গ্রুপিং রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করতে,বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডকে প্রশ্রয় দেয়।আগে একটা সময় ছিল যখন এলাকায় কোনো যুবক,অন্যায় কিছু করলে যে কোনো সিনিয়র কেউ শাসন করতে পারতো,ফলে সংশোধনের একটা সুযোগ ছিলো।এখণ সেই কালচার প্রায় বিলুপ্তির পথে।অন্য কারো সন্তানকে কেউ,ভালোর জন্য কিছু বলতে গেলেও,আরো কথা শুনতে হয়,ঐ সন্তানদের পিতা-মাতায় বলে বসে,আমার সন্তানকে তুমি শাসন করার কে?আর বেপরোয়া হয়ে উঠার পিছনের আরেকটা কারণ হলো-মাদকাসক্তি।কিশোরং গ্যাং এর সদস্যরা তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে ১০-১৫ জন মিলে বিভিন্ন ন্যাককারজনক মারামারি,ছিন্তায় সহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ড ঘটিয়ে থাকে।এলাকার একজন মাস্টার চাচাকে বলা হয়েছিলো,আপনারা এলাকার বেপরোয়া কিশোরদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার করেন না কেন?উনি দুঃখ নিয়ে বলেছিলেন- এরা এতোটাই বেপরোয়া যে,রাস্তা-ঘাটে একা পেয়ে যে ছুরি মারবে না বুকে এটার কি গ্যারান্টি আছে?এ কথা শুনার পর নিঃস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।এদের সঠিক বিকাশের জন্য প্রয়োজন সুস্থ বিনোদন,সঠিক শিক্ষা ব্যবস্থা।স্কুলে যখন পড়তাম তখন দেখতাম বিকালে এলাকার প্রায় প্রত্যকটা মাঠ,ফুটবল,ক্রিকেট ইত্যাদি বিভিন্ন খেলায় প্রাণবন্ত থাকতো।আর সন্ধ্যার আগেই প্রায় সবাই খেলা শেষ করে বাড়ি গিয়ে পড়াশোনা করে,ঘুমাতো।সকাল হতে বিকাল পর্যন্ত পড়াশোনা,স্কুল।হঠাৎ করেই এ দৃশ্যপট বদলে গেছে,এখনকার কিশোররা স্মার্টফোনের ভিতর বিভিন্ন অনলাইন গেইম,টিকটক ইত্যাদিতে ছোট্র একটা ডিভাইসে নিজেদের জগৎকে আবদ্ধ করে ফেলেছে,নিজেদের জগতে নিজেদেরকে রাজা ভাবতে শুরু করেছে।দিন রাত পড়াশুনা বাদ দিয়ে,একটি অসুস্থ ধারায় জীবনের মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট করছে।আর মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে কিশোর গ্যাং তৈরি করে,কোনো নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে সংঘবদ্ধভাবে শহর থেকে গ্রামে প্রত্যেকটা এলাকায় এরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে।আর সামান্য কিছু নিয়েও মারামারি করে হত্যার মত ন্যাককারজনক,জঘন্যতম ঘটনাও ঘটাচ্ছে।এসব কিছুর লাগাম টেনে না ধরতে পারলে,আল্লাহ না করুক এই জাতিকে চরম মূল্য দিতে হবে।এজন্য পরিবার,সমাজ,রাষ্ট্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সকলকে এক যুগে কাজ করে একটি সুস্থ জাতি বিনির্মানে এগিয়ে আসতে হবে।মৌলিক চাহিদা, সুস্থ বিনোদন,সঠিক শিক্ষা ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে।নিজেদের স্বার্থে যারা কিশোর গ্যাং এর সদস্যদের প্রশ্রয় দেয় ওদেরকেও তদন্ত সাপেক্ষে আইনের আওতায় এনে, কিশোর গ্যাং এর শিকড়কে উপড়ে ফেলতে হবে।আর দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক কিশোর সংশোধন কেন্দ্র নেই।দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক কিশোর সংশোধন কেন্দ্র নির্মাণ করে মনোবিজ্ঞানী, চিকিৎসক এর মাধ্যমে কিশোরদের সঠিক কাউন্সিলিং নিশ্চিত করতে হবে।আর পরিবার,সমাজ,রাষ্ট্র
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান,সুশীল সমাজ,শিক্ষাবিদ,আইনজীবী,বুদ্ধিজীবী,সাংবাদিক, রাষ্ট্রীয় নীতি-নির্ধারণী ফোরাম,সরকার সহ ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট সকলকেই যে যার অবস্থান থেকে সচ্চার হতে হবে।বেপরোয়া হয়ে ওঠার আগেই কিশোরদের সঠিক শিক্ষা,সুস্থ বিনোদন ইত্যাদি সব কিছু নিশ্চিত করতে এগিয়ে আসতে হবে।সকলের সম্মিলিত প্রয়াসই পারে কেবল কিশোর গ্যাং এর কালচারের অবসান ঘঠিয়ে একটি সুস্থ পরিবার,সমাজ,জাতি,রাষ্ট্র গঠন করতে।আমিও স্বপ্ন দেখি একদিন এই কিশোর গ্যাং কালচারের অবসান ঘটবে।তাইতো শেক্সপিয়ারের উক্তিটি বলতে চাই-” The miserable have no other medicine but only hope”(শুধুমাত্র আশা ছাড়া হতভাগ্যদের আর কোনো ঔষুধ/তাবিজ নেই।আমিও আশাবাদী ইনশাআল্লাহ,
একটি সুস্থ জাতি বির্নিমানে সকলেই এগিয়ে আসবে এই কামনাই করি।
লেখক:
মোঃমাসুম বিল্লাহ বিবিএ, এমবিএ,মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ,জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।
আপনি যা যা মিস করেছেন
Add A Comment