রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজারে শ্যামবাজারে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের অভিযানে ও দেশি মুড়িকাটা পেঁয়াজের সরবরাহ বাড়ায় পেঁয়াজের দাম কমেছে। প্রতি কেজি মুড়িকাটা দেশি পেঁয়াজ ৯০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা একদিন আগেও বিক্রি হয়েছে ১১০ থেকে ১৩০ টাকায়।
সে হিসাবে কেজিতে ৩০ টাকা দাম কমেছে। তবে পাইকারিতে দাম কমলেও খুচরা পর্যায়ে কমেনি দাম। একই সঙ্গে দেশি হালি পেঁয়াজের দামও কিছুটা কমেছে।
সোমবার (১১ ডিসেম্বর) রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে বড় আড়ত শ্যামবাজার ঘুরে দেখা গেছে, আমদানিকৃত পেঁয়াজ কমেছে। বেড়েছে দেশি মুড়িকাটা পেঁয়াজ। প্রায় প্রতিটি ঘরে মুড়িকাটা পেঁয়াজ।
গতকাল রোববার ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর শ্যামবাজারে অধিযান চালিয়ে অনেক ব্যবসায়ীকে জরিমানা করেছে। ফলে একদিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম কেজিতে মানভেদে ২০ থেকে ৩০ টাকা কমেছে। সেমাবার পাইকারি এক কেজি মুড়িকাটা দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৮০ থেকে ১০০ টাকা দরে। আর আমদানিকৃত (এলসি) পেঁয়াজ ১২৫/১৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে পাইকারিতে দাম কমলেও খুচরা পর্যায়ে কমেনি পেঁয়াজের দাম। খুচরা বাজারে ও পাড়া-মহল্লায় প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ২৩০ থেকে ২৪০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। আর আমদানিকৃত পেঁয়াজ ১৯০ থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
এ বিষয়ে শ্যামবাজারের নিউ মেসার্স আলী ট্রেডার্সের ম্যানেজার সুজন সাহা বাংলানিউজকে বলেন, আমদানি হওয়া ও ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের অভিযানের পর শ্যামবাজারে পেঁয়াজের দাম কমেছে। নতুন করে এলসি না হলেও আগের এলসি মাল সেগুলো আসছে। বাজারে প্রচুর পেঁয়াজ আছে। গতকাল রাতে দেশের মুড়িকাটা পেঁয়াজের অনেক ট্রাক ঢুকেছে। ফলে আজকে দাম কমেছে। আজকে পাইকারি এক কেজি মুড়িকাটা দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৮০ থেকে ১০০ টাকা দরে। যা এক দিন আগেও বিক্রি হয়েছে মানভেদে ১১০ থেকে ১৩০ টাকা কেজি। সে হিসাবে দাম কমেছে কেজিতে ৩০ টাকা।
তিনি বলেন, শুক্রবার বিকেল থেকে হুজুকে পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকে। শনিবার সেটা পাইকারিতে সর্বোচ্চ দেশি হালি পেঁয়াজের দাম উঠেছে ২১০ টাকা কেজি। আর মুড়িকাটার দাম ১৩০ টাকা। বর্তমানে হালি পেঁয়াজের মৌসুম শেষ। দুই এক ঘরে পাওয়া যেতে পারে। সেখানেও দাম ২০ থেকে ৩০ টাকা কমে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
একই বাজারে মেসার্স রাজিব বাণিজ্য ভান্ডারের ক্যাশিয়ার দিলীপ সাহা বাংলানিউজকে বলেন, দেশের মুড়িকাটা পেঁয়াজ বাজারে ব্যাপক হারে চলে এসেছে তাই দাম কমেছে। এখন প্রতি কেজি মানভেদে ৮০/৮৫ টাকা। শুক্রবার হুজুগে দাম বেড়েছে। আমাদের লাভ লস নেই। আমরা প্রতি কেজিতে ৩০ পয়সা পাই। লস হয়েছে পাইকারদের। তবে কিছুদিন পরে নতুন হালি পেঁয়াজ বাজারে চলে আসবে তখন দাম আরও কমে যাবে। গতরাতে অনেক পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। এরকম যদি আজকে রাতেও আসে তাহলে দাম আরও কমে যাবে। এটা ৬৫ থেকে ৭০ টাকায় চলে আসবে।
আমদানিকৃত পেঁয়াজ বিক্রি করে স্মৃতি বাণিজ্যালয়ের ম্যানেজার সুমন ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, গতকাল ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর শ্যামবাজারে অভিযান চালিয়ে অনেক ব্যবসায়ীকে জরিমানা করেছে। এরপর থেকেই বাজারে পেঁয়াজের দাম কমতে শুরু করে। বর্তমানে আমদানিকৃত (এলসি) পেঁয়াজ ১২৫/১৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। যা শনিবারও ১৬০/১৬৫ টাকা বিক্রি হয়েছে। মূলত ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম উঠিয়েছে। আমরা তো পাইকারদের কথামতো মাল বিক্রি করি।
শ্যামবাজারে কথা হয় ঈশ্বরদীর আতিয়ার মোল্লার সঙ্গে। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার বিকেলে ভারত রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করার পর থেকেই বাজার অস্থির। শুক্রবার সকালে ঈশ্বরদীতে হঠাৎ পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায়। সেদিন আমি ৪ হাজার টাকা মণ পেঁয়াজ কিনে ৬ হাজার টাকা মণ বিক্রি করেছি। এরপর শনিবার দিন ৬ হাজার টাকা মণ কিনে ৪ হাজার করে বিক্রি করেছি। এখানে আমার মণে দুই হাজার টাকা লোকসান হয়েছে। আসলে বেশি লাভের কথা চিন্তা করেই এ অবস্থা হয়েছে। আমি তো চালান উঠাতে পেরেছি। অনেকেই চালান ওঠাতে পারেনি। আমরা তো ছোট ব্যবসায়ী, বড় যারা আছে তারা সিন্ডিকেট করেই বাজারে পেঁয়াজের দাম উঠিয়েছে। যা কামানোর তারা দুই দিনেই কামিয়ে নিয়েছে। এখন বাজারে মুড়িকাটা পেঁয়াজ চলে এসেছে, দাম আর বাড়ার সম্ভাবনা নেই। সামনে দাম আরও কমবে।
রোববার কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতি জানানো হয়, প্রতি বছর মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদ হয় প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে এবং উৎপাদন হয় প্রায় ৮ লাখ মেট্রিক টন। এছাড়া এ বছর গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে প্রায় ৫০০ হেক্টর জমিতে। এই মুড়িকাটা ও গ্রীষ্মকালীন নতুন পেঁয়াজ ক্ষেত থেকে তোলা ও বাজারে আসা শুরু হয়েছে এবং বাজারে থাকবে ৩ থেকে সাড়ে তিন মাস। এরপর মূল পেয়াঁজ আসা শুরু হবে এবং উৎপাদন হতে পারে প্রায় ২৬ থেকে ২৮ লাখ মেট্রিক টন।
চলতি বছরের জুলাই থেকে এ যাবত (০৯-১২-২৩ পর্যন্ত) আমদানি হয়েছে ৫ লাখ ৭১ হাজার ৫৩৪ টন, যা গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এক লাখ ৫৫ হাজার ২২৪ টন বেশি। (গত বছর এই সময়কালে হয়েছিল ৪ লাখ ১৬ হাজার ৩১০ টন)।
গত ৭ ডিসেম্বর নিজেদের বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ স্বাভাবিক ও দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে আগামী মার্চ পর্যন্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটির রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। ভারতের ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরেন ট্রেড বা বৈদেশিক বাণিজ্যবিষয়ক মহাপরিচালকের কার্যালয় গত বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, আগামী বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ থাকবে। এই নির্দেশনা গত শুক্রবার থেকে কার্যকর হয়েছে।
এর আগে বিরূপ আবহাওয়ায় ফলন ভালো না হওয়ায় ভারত নিজেদের বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে গত ২৯ অক্টোবর প্রতি টন পেঁয়াজের ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য ৮০০ মার্কিন ডলার নির্ধারণ করে দেয়। আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই বিধিনিষেধ দেওয়া হয়। কিন্তু সেই সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। তবে কোনো দেশের সরকারের অনুরোধে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার রপ্তানির সুযোগ দিতে পারবে বলে দেশটির ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরেন ট্রেডের (ডিজিএফটি) আদেশে জানানো হয়েছে।
এছাড়া, ইতোমধ্যে যারা পেঁয়াজ আমদানির এলসি চালু করেছেন, তাদের মধ্যে যারা আদেশ জারির আগেই পণ্য জাহাজিকরণ শুরু করেছেন, তারা এর আওতামুক্ত থাকবেন। এছাড়া শিপিং বিল দপ্তরে জমা দিলে এবং সংশ্লিষ্ট জাহাজ বন্দরে ভিড়লে বন্দর কর্তৃপক্ষ এ ধরনের চালান অনুমোদন করতে পারবে।
বর্তমানে ভারতের খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৫০ থেকে ৬০ রুপির মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু রপ্তানি বন্ধের সংবাদে বাংলাদেশে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা ও আমদানিকৃত পেঁয়াজের দাম ২০০ টাকায় উঠে গেছে। যা একদিন আগেও যথাক্রমে দেশি পেঁয়াজ ১২০ থেকে ১৩০ টাকা, আর আমদানিকৃত পেঁয়াজ ১০৫ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত কিছুদিন ধরেই দেশের পেঁয়াজের বাজার অস্থির। গত ১৪ সেপ্টেম্বর বাজার নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজের খুচরা দর সর্বোচ্চ ৬৫ টাকায় নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু এ দরে খুচরা বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি হতে দেখা যায়নি। পরে সরকার পেঁয়াজ আমদানি উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এরপরও পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে আসেনি।