ভারত করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের চালান বন্ধ করে দেওয়ার পর বাংলাদেশের টিকাদান কর্মসূচীর প্রচেষ্টা বড় ধরনের আঘাত পেয়েছে। নতুন সংক্রমণ ও ক্রমবর্ধমান মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধির সময় ভারত রপ্তানি থামিয়ে দিয়েছে।
ইংরেজীতে ছাপা জার্মানির ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদনে রাজধানী ঢাকায় বসবাসরত সাংবাদিক মুহিউদ্দিন নিলয়ের এক ফেসবুক পোস্টের উদাহরণ দিয়ে বলা হয়- তিনি টিকাকেন্দ্রে হাসিখুশি মুখে নিজের ছবি পোস্ট করে ফেসবুকে লিখেন, “করোনা ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ নিলাম।” তিনি কয়েক হাজার বাংলাদেশির মধ্যে একজন, যিনি এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিনের দুই ডোজ পেতে সক্ষম হয়েছেন।
করোনাভাইরাসের এক নতুন ঢেউ গত এক মাস ধরে বাংলাদেশ প্রবাহিত হয়েছে যাতে প্রতিদিন সংক্রমণ সাতগুণ এবং মৃত্যুর হার তিনগুণ বেড়েছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৭,০০,০০০ আক্রান্ত এবং প্রায় ১০,০০০ মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মৃত্যু এবং সংক্রমণের প্রকৃত হার আরও বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়- তারা বলছেন, প্রকৃত চিত্র নির্ধারণ করা খুব কঠিন কারণ দেশটির ১৬ কোটি ৭০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে খুব কম সংখ্যক লোকই করোনা পরীক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন।
বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে ১ কোটিরও বেশি ভ্যাকসিনের ডোজ গ্রহণ করতে পেরেছে, কিছু উপহার হিসাবে, এবং বাকীগুলো ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট (এসআইআই) এর সাথে বাণিজ্যিক চুক্তির অংশ হিসেবে, যা অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকার করোনার ভ্যাকসিন তৈরি করছে।
নিলয় ডয়চে ভেলেকে বলেন, “বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ খুব দ্রুত টিকা কার্যক্রম শুরু করেছিল।”
“একটি অনলাইন রেজিস্ট্রেশন সিস্টেমের মাধ্যমে সুন্দরভাবে এটি করা হচ্ছে। কোন সমস্যা ছাড়াই আমি কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে উভয় ডোজ পেয়েছি,” তিনি যোগ করেন।
“এস্ট্রাজেনেকার কোভিড ভ্যাকসিন নিয়ে সন্দেহ” রয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়ঃ
অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন সম্পর্কে সবার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নেই। এই মুহুর্তে বাংলাদেশ করোনার বিরুদ্ধে একমাত্র এটি-ই ব্যবহার করছে।
কিছু লোক সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি দেশ উত্থাপিত সুরক্ষা ইস্যুর কারণে এই ভ্যাকসিন গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ঢাকার একজন স্কুল শিক্ষিকা শানু অর্পিতা বলেছিলেন যে তিনি এই ভ্যাকসিনকে কার্যকর মনে করেন না।
“আমি মনে করি না এস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন কোন প্রভাব ফেলবে কারণ আমি এর কার্যকারিতার স্বপক্ষে কোনও সুদৃড় প্রমাণ দেখি নি।”
“সরকার কয়েকটি খাতের জন্য ভ্যাকসিন গ্রহণ বাধ্যতামূলক করেছে। তবে আমার মতো সাধারণ মানুষরা এটি গ্রহণে আত্মবিশ্বাসী নই,” তিনি যোগ করেন।
ভ্যাকসিনের সুরক্ষা এবং কার্যকারিতা সম্পর্কে সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও, ফেব্রুয়ারিতে টিকাদান শুরু হওয়ার পর থেকে লাখ লাখ লোক তা নিতে অনলাইনে নিবন্ধন করেছেন।
এখন অবধি প্রায় ৫৬ লাখ লোক ভ্যাকসিনের কমপক্ষে একটি ডোজ পেয়েছেন। আর প্রায় ৫০,০০০ লোক দুই ডোজ পেয়েছেন।
“ভারত ভ্যাকসিন রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে” অংশে ডয়চে ভেলে জানায়ঃ
বাংলাদেশ এখন তার নাগরিকদের ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব’ ভ্যাকসিন দিতে পারবে কিনা তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে আশংকা করছে। দেশটি ভ্যাকসিনের ৩ কোটি ডোজ প্রস্তুত করার জন্য ২০২০ সালে সেরামের সাথে একটি বাণিজ্যিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
চুক্তি অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে প্রতি মাসে তার ৫০ লাখ ডোজ করে পাওয়ার কথা।
কিন্তু ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের প্রথম দুই মাসে এই চুক্তির আওতায় দেশটি কেবল ৭০ লাখ ডোজ পেয়েছে। বাকি ৩০ লাখ ডোজ ভারত সরকার অনুদান হিসেবে দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, সংক্রমণের মাত্রা তীব্রভাবে বৃদ্ধির মধ্যে ভারত তার অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য সেরাম কর্তৃক তৈরি ভ্যাকসিন গত মাসে রপ্তানি বন্ধ করায় বাংলাদেশের টিকাদান কর্মসূচি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে।
এটা এখনও স্পষ্ট নয় সেরাম কবে আবার প্রতিশ্রুত ভ্যাকসিনের ডোজ সরবরাহ করতে সক্ষম হবে, তবে বাংলাদেশ সরকার আশা করছে সেগুলো তারা শিগগিরই পাবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমরা ইতিমধ্যে ভ্যাকসিনের নির্দিষ্ট পরিমাণ ডোজের জন্য যে টাকা দিয়েছি সেগুলো পাওয়ার জন্য আমরা ভারতের সাথে যোগাযোগ করছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত মাসে ঢাকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে এ বিষয়ে কথা বলেছেন।”
“আমাদের কাছে এখনও ভ্যাকসিন রয়েছে, তাই টিকাদান কার্যক্রম চলছে,” তিনি আরও বলেন, “বর্তমান মজুদ শেষ হওয়ার আগেই আমরা নতুন ভ্যাকসিন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী।”
“বাংলাদেশের আরও অনেক টিকার উৎস দরকার” অংশে ডয়চে ভেলের প্রতিবেদনে বলা হয়ঃ
পর্যবেক্ষকরা বলছেন ভারত সংক্রমণের এক নতুন ঢেউ মোকাবেলার জন্য লড়াই চালাচ্ছে। তাই শীঘ্রই ভ্যাকসিন রপ্তানি পুনরায় চালু করা সম্ভব হতে পারে না।
গত ২৪ ঘন্টায় ভারতে ১,৮৪,৩৭২ নতুন শণাক্ত এবং ১,০২৭ টি নতুন মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে, যা আবারো সর্বোচ্চ দৈনিক রেকর্ড। বিশ্বব্যাপী প্রতি ছয়টি নতুন সংক্রমণের মধ্যে একটি এখন ভারতে।
ভ্যাকসিনের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে, ভারত সরকার পশ্চিমা দেশ এবং জাপান কর্তৃক অনুমোদিত করোনার ভ্যাকসিনগুলোর জরুরী অনুমোদনের দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়ে ভাবছে যা, বায়োএনটেক-ফাইজার, জনসন এন্ড জনসন এবং মডার্না ভ্যাকসিনের সম্ভাব্য আমদানির পথকে প্রশস্ত করেছে।
বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষের জন্য কমখরচে চিকিৎসা প্রদানকারী সংস্থা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ঢাকা করোনা ভ্যাকসিনের জন্য একটিমাত্র উৎসের উপর নির্ভর করে ভুল করেছে।
চৌধুরী বলেন, “রাশিয়া সহ অন্যান্য দেশ থেকে আমাদের ভ্যাকসিন নেওয়ার সুযোগ ছিল, কিন্তু সরকার সেসব সুযোগ গ্রহণ করার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হয়।”
“আমাদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের জন্য স্থানীয়ভাবে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারের তা নিয়ে কাজ করা দরকার,” তিনি যোগ করেন।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী হোসেন বলছিলেন, সামনের মাসগুলোতে দেশের ৮০% জনগণকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করার কারণে তার সরকার অন্যান্য উৎস থেকে ভ্যাকসিন নেওয়ার চেষ্টা করছে।
“আমরা এই লক্ষ্য অর্জন না করা পর্যন্ত আমাদের মাস্ক পরে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এবং নিয়মিত হাত ধুয়ে নিরাপদ থাকতে হবে,” তিনি বলছিলেন।
এদিকে, দক্ষিণ আফ্রিকাতে প্রথম শনাক্ত হওয়া ভ্যারিয়েন্ট (যেটি বিশ্বব্যাপী অন্যান্য বহু ভ্যারিয়েন্ট এর চেয়ে অনেক বেশি সংক্রামক বলে বিবেচিত) এর বিস্তাররোধে বাংলাদেশ এক সপ্তাহের জন্য কঠোর লকডাউন দিয়েছে।