মতিঝিলের একটি ট্রাভেল এজেন্সি থেকে দুবাইয়ের টিকিট নেন মিরসরাইয়ের আজাহার উদ্দিন। তিনি ভিজিট ভিসায় দুবাই যেতে চান। যদিও আজাহারের উদ্দেশ্য দুবাই গিয়ে কাজ করা। বাবা ও চাচারা থাকেন সেখানে। টিকিট বিক্রি শেষে এজেন্সির এক কর্মচারী জিজ্ঞেস করেন ‘এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্ট’ হয়েছে কি না। লাগবে না বলে টিকিট নিয়ে তিন দিন পর এয়ারপোর্টে যান আজাহার। কিন্তু বিমানবন্দরে চার ঘণ্টা বসে থেকে বেরিয়ে আসতে হয় তাকে। ইমিগ্রেশন থেকে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাসপোর্টে দেওয়া হয়েছে অফলোড সিল।
গত জানুয়ারিতে এসব ঘটনা ঘটলেও ফেব্রুয়ারির শুরুতে ঠিকই দুবাই যান আজাহার ও ছোট ভাই আতাহার। এবার দুই ভাই ২ লাখ টাকার এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্ট করেই গিয়েছিল বিমানবন্দরে। গতকাল আজাহার দুবাই থেকে ফোনে জানালেন, ‘আব্বা চেনা দালাল ঠিক করে দিয়েছিল তাই টাকা কম লেগেছে’। আজাহারের সঙ্গে একই ফ্লাইটে দুবাই যাওয়া সিলেটের বিয়ানীবাজারের আরিফ বলেন, ‘আমার যাওয়ার ইচ্ছা ইউরোপে। দুবাই থেকে দালালদের মাধ্যমে যাওয়াটা সহজ হবে, তাই এসেছি। এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্ট ছাড়া যে যাওয়া যায় না তা আগে থেকেই জানতাম। তাই ১ লাখ ৬৮ হাজার টাকায় চুক্তি করে নিয়েছিলাম। বিমানবন্দরে কোনো সমস্যাই হয়নি।’
অন্যদিকে কভিড সতর্কতার কারণে কুয়েতে সরাসরি প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকায় ভারত ও পাকিস্তানিদের মতো দুবাই হয়ে কুয়েতে যাচ্ছেন বাংলাদেশিরাও। তারাও ভিজিট ভিসায় যাচ্ছেন দুবাইতে। গতকাল কুয়েত থেকে ফেনীর দুলাল জানালেন, ৭ ফেব্রুয়ারি কুয়েতের উদ্দেশ্যে দুবাই যেতে চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে যাই। বোর্ডিং পাসের জন্য দাঁড়াতেই এক কাউন্টার থেকে আরেক কাউন্টারে ঠেলাঠেলি শুরু হয়। পরে বলা হয় যাওয়া যাবে না, আরও কাগজপত্র লাগবে। কথাবার্তার মধ্যেই বিমানবন্দরের এক সিকিউরিটি ১ লাখ টাকায় সব ঠিক করে দেওয়ার কথা বলে। ডলার সঙ্গেই ছিল, দেওয়ার পর আসতে দিল। দুলাল বলেন, নিচের স্তর থেকে ওপরের স্তর পর্যন্ত পুরো একটা সিন্ডিকেট এর সঙ্গে জড়িত। এই সিন্ডিকেটের কারণেই বাংলাদেশিদের টাকা বেশি লাগে। আমার কোম্পানিতে ভারত ও পাকিস্তানের সহকর্মীরা যে টাকায় এসেছেন তাদের দ্বিগুণ-তিনগুণ টাকা লাগে বাংলাদেশিদের।
মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীরা বলছেন, বিমানবন্দরের কিছু অসাধু কর্মচারী বৈধ ভিজিট ভিসাসহ যাবতীয় ট্রাভেল ডকুমেন্ট থাকা সত্ত্বেও ভিজিট ভিসাধারীদের আসতে বাধা দিচ্ছে। তারা কেবল ‘কন্ট্রাক্ট বাণিজ্যে’র মাধ্যমে ভিজিট ভিসাধারীদেরই আসতে দিচ্ছে। যারা ‘কন্ট্রাক্ট’ করছে না, তাদের আটকে দিচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে ৫০ হাজার টাকা বিমান ভাড়ায় যেখানে আমিরাতে আসতে পারতেন, এখন তাদের দেড় লাখ থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকায় তথাকথিত ‘চুক্তি’ করতে হচ্ছে।
জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা জানান, ইউএইতে একটি ভিজিট ভিসা নিতে খরচ হয় প্রায় ১৫ হাজার টাকা। তবে কাজের আশায় ভিজিট ভিসা নিয়ে যারা যাচ্ছে তাদের সব মিলিয়ে খরচ করতে হয় আড়াই-তিন লাখ টাকা। একশ্রেণির অসাধু এজেন্সি, দালাল চক্র ও বিমানবন্দরের কিছু কর্মচারী মিলে ‘এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্ট’ নামে ভিজিট ভিসাধারীদের ইউএই প্রবেশের ব্যবস্থা করছে। এ জন্য প্রায় জনপ্রতি লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়।
দুবাইতে প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আট বছরেরও বেশি সময় ধরে আমিরাতে বাংলাদেশিদের ভিসা বন্ধ। যা আমাদের এই সম্ভাবনাময় শ্রমবাজারটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকার ভিজিট ভিসায় বাংলাদেশিদের বৈধভাবে আমিরাতে আসার সুযোগ দিচ্ছে। ভিজিট ভিসায় আমিরাতে আসার পর ভিসা স্ট্যাটাস পরিবর্তন করে কোম্পানির ভিসা বা পার্টনার ভিসা লাগানোর সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের এয়ারপোর্টে ভিজিট ভিসাধারীদের আটকে দেওয়া হচ্ছে। কন্ট্রাক্ট বাণিজ্য ভিসা, টিকিটের মতো হয়ে গেছে। ভিসা-টিকিট না থাকলে যেমন বিদেশ যাওয়া যায় না, তেমনি এখন ভিসা-টিকিট থাকলেও ইমিগ্রেশন পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ না করলে বিদেশ যাওয়া যায় না।
এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্ট তৈরি করছে মানব পাচারের সুযোগ : গত মাসে লিবিয়া থেকে ফেরত আসে সাতটি লাশ এবং ১৪৮ বাংলাদেশি। তারা প্রত্যেকেই ইউরোপে যাওয়ার উদ্দেশ্যে প্রথমে ভিজিট ভিসায় দুবাই গিয়েছিল। সেখানে কিছু দিন থাকার পর ইউরোপে যাওয়ার জন্য লিবিয়া যান তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভিজিট ভিসা প্রাপ্তি সহজ হওয়ার সুযোগে প্রতারণায় নামে একশ্রেণির দালাল চক্র। সাধারণ মানুষকে ইউরোপের প্রলোভন দেখিয়ে ভিজিট ভিসার মাধ্যমে ইউএইতে নেওয়া হচ্ছে। এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্টের কারণে এসব পাচার ঠেকানোও যাচ্ছে না।