স্টাফ রিপোর্টার : নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের অবহেলায় এক রোগী মারা যাওয়ার প্রতিবাদ করায় ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। পরে ওই ছাত্রলীগ নেতা শাহারিয়ার আসিফ ইমনকে (২৭) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অন্যায়ের প্রতিবাদকারী ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেপ্তার করায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার মুক্তির দাবি ও অবহেলাকারী চিকিৎসকের শাস্তির দাবি করেছে অন্য ছাত্রলীগ নেতাকর্মীসহ সাধারণ লোকজন।
ইমন মোহনগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির পাঠাগার বিষয়ক সম্পাদক। তিনি বারহাট্টা উপজেলার মল্লিকপুর গ্রামের এস এম ছালেক হায়দারের ছেলে। ছালেক হায়দার পরপর দুইবার সিংধা ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে তারা মোহনগঞ্জ পৌরশহরের নওহাল এলাকায় বসবাস করেন।
স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মাহমুদা খাতুন বাদী হয়ে এ মামলা করেন। মোহনগঞ্জ থানার ওসি রাশেদুল হাসান মামলার পর ইমনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ইমনের সহকর্মীরা জানায়, গত সোমবার (১৩ জুন) উপজেলার গাগলাজুর ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মৃত রহুল আমীন ছদ্দুর স্ত্রী ফরিদা পারভীনকে (৫০) অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান ইমন। ফরিদা পারভীনের শ্বাস কষ্ট বেড়ে যায়। এ সময় কর্তব্যরত চিকিৎসক (সেকমো) আলমগীর হোসেনকে বিষয়টি জরুরি দেখতে বললেও তিনি কর্ণপাত করেননি। দ্রুত চেক করার তাগাদা দিলে আলমগীর রোগীর সাথে থাকা ইমনের সাথে খারাপ আচরণ করেন। পরে রোগীকে চিকিৎসা না করে ময়মনসিংহ রেফার্ড করে দেন।
এ সময় ইমন সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের খোঁজ জানতে চাইলে কোনরকম সহযোগীতা করেননি। উল্টো প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে যেতে বলেন। এসব করে আলমগীর হোসেন আধঘণ্টা কাটিয়ে দেন। পরে দেরিতে প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে গেলে ময়মনসিংহ যাবার পথেই রোগীর মৃত্যু হয়।
তারা আরও জানায়, ফরিদা পারভীনকে গ্রামের বাড়িতে দাফন শেষে বুধবার রাত পৌনে ৯টায় ডিউটি শেষে ফেরার পথে সেকমো আলমগীরকে পেয়ে ইমন ক্ষোভ দেখায়। এ নিয়ে তর্ক বিতর্কের এক পর্যায়ে ইমনের এক বন্ধুর সাথে আলমগীরের হাতাহাতি হয়। কিন্তু এই ঘটনায় আলমগীর হামলার অভিযোগ এনে বিছানায় শুয়ে থাকে। এছাড়া তাকে ডিউটিরত অবস্থায় মারধর করা হয়েছে বলেন আলমগীর। যদিও এদিন তার ডিউটি ছিল রাত ৮টা পর্যন্ত। নিজের অপকর্ম আড়াল করতেই এসব নাটক সাজিয়েছেন আলমগীর। পরে অন্য চিকিৎসকদের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে জরুরি বিভাগের চিকিৎসা সেবা বন্ধ রাখা হয়। এ ঘটনায় কিছু সময় পরে মামলা হলে ইমনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। দ্রুত এ মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি তাদের।
স্থানীয়রা জানায়, মোহনগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি চিকিৎসকদের অবহেলায় এর আগেও অনেক রোগী মারা গেছেন। সিঁড়িতেই অনেক প্রসূতির বাচ্চা প্রসব হয়েছে। প্যারাসিটামল ছাড়া কোন ওষুধ হাসপাতাল থেকে দেওয়া হয় না। প্রতিবাদ করায় রোগীর স্বজনের নামে এরআগেও কয়েকবার মামলা দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেবার বদলে অবহেলা পেলে তো রোগীর স¦জনরা ক্ষিপ্ত হবেই। এছাড়া অনিয়ম দুর্নীতি তো আছেই।
ছাত্রলীগ নেতা ইমন জানায়, ওইদিন রোগী নিয়ে জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখি মেডিকেল অফিসার নাই। আলমগীর নামে একজন সেকমো আছেন শুধু। তিনিই সব চিকিৎসা করেন। তাকে তিনবার প্রশ্ন করলে একবার জবাব দেন। শ্বাস কষ্টের রোগী দ্রুত করেন তাগাদা দিতেই ক্ষিপ্ত হন আলমগীর। অক্সিজেন লাগাতে গিয়ে আধাঘণ্টা সময় নষ্ট করেন তিনি। একপর্যায়ে রাগে রোগী রেফার্ড করে দেন।
এ সময় সরকারি অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যাবে কিনা পরামর্শ চাইলে তিনি প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্সের চালকের নাম্বার দিয়ে বলেন, সরকারিটা দিয়ে ইউএইচএফপিও ম্যাডাম ঘুরতে বের হয়েছে ওইটা পাওয়া যাবে না। অক্সিজেন লাগাতে গিয়ে আধাঘণ্টা সময় নষ্ট করেন তিনি। দেরিতে প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে যাওয়ায় পথেই রোগী মারা যায়। দুইদিন পর ডিউটি শেষ করে যাবার পথে তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে ফের খারাপ আচরণ করে। পরে এ নিয়ে তর্কতর্কি হয়। এক পর্যায়ে কিছুটা হাতাহাতি হয়েছে। কিন্তু আলমগীর এটাকে হামলার নাটক সাজায়। বিছানায় শুয়ে নাটক করে মামলা দেয়। হাসপাতালের অনিয়ম, চিকিৎসকদের অবহেলা কারো অজানা নয়। প্রতিবাদ করলেই মামলা দিয়ে চুপ করায়।
ছাত্রলীগ নেতা আল মামুন জানায়, হাসপাতালে চিকিৎসকরা কেমন ব্যবহার করে এটা সবাই জানে। মামলার ভয়ে অনেকেই প্রতিবাদ করে না। ইমন হয়তো সাহস করে সেটা করেছে। হাসপাতালের অনিয়ম, চিকিৎসকদের অবহেলা আড়াল করতেই এই মামলা। প্রহসনের মামলা প্রত্যাহার করা হোক।
উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (সেকমো) আলমগীর হোসেন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি সঠিকভাবে চিকিৎসা করেছি। কোন অবহেলা হয়নি। সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের চালকের নাম্বার চেয়েছিল আমি নাম্বার জানি না বলেছি। এতেই সে ক্ষিপ্ত হয়। আমাকে পরে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়। এর জেরে হাসপাতালের সামনে রাত পৌনে ৯টায় কয়েকজনকে সাথে নিয়ে আমাকে মারধর করে। এদিন আমার ডিউটি আটটায় শেষ হয়। তবে পরের সময়টা সহকর্মীর জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
ইউএইচএফপিও ডা. মাহমুদা খাতুন বলেন, আমি কিছুদিন হলো জয়েন করেছি। শুরু থেকেই চিকিৎসকদের নানা অনিয়ম লক্ষ্য করছি। যেসব মেশিন হাসপাতালে রয়েছে সেসব পরীক্ষা বাইরের ল্যাবে না দিতে বলেছি। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। ইতিমধ্যে সব চিকিৎসককে এ বিষয়ে কয়েক দফা সতর্ক করা হয়েছে। দালাল মুক্ত হতেও বলা হয়েছে। কথায় কাজ না হলে ব্যবস্থা নেব। পুরো হাসপাতালে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবো।
তিনি আরও বলেন, সেকমো আলমগীরকে মারধরের ঘটনায় মামলা হয়েছে। তবে এ ঘটনায় আলমগীরের অবহেলা আছে কিনা সেই বিষয়টি খতিয়ে দেখবো।