নকল সিগারেটের ব্যান্ডরোলের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন খোদ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র আব্দুস সবুর লিটন। এ কাজে সরাসরি যুক্ত তার ভাই আব্দুল মান্নান খোকন।
এমনকি নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীর নামে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান খুলে তারা নকল ব্যান্ডরোল আমদানি করেন।
পরবর্তী সময়ে সেগুলো নিজেদের সিগারেট কারখানায় ব্যবহার করা হয়। সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।
এদিকে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে পণ্য আমদানি-রপ্তানি এবং নগদ সহায়তা জালিয়াতির ব্যাপকতা তুলে ধরে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ৬টি সুপারিশ করা হয়।
গত বছর চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃক জব্দকৃত দুটি নকল ব্যান্ডরোলের চালানের কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাপ্পু এন্টারপ্রাইজ ও আরাফাত এন্টারপ্রাইজ ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর), বিআইএন (ব্যবসা নিবন্ধন নম্বর) এবং আইআরসি (আমদানি সনদ) গ্রহণ করেছে।
বাপ্পু এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী বাপ্পু বড়ুয়া পেশায় একজন রংমিস্ত্রি। তিনি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। অপরদিকে আরাফাত এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আরাফাত হোসেন ইলেকট্রিক পণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূলত আরাফাত হোসেন ব্রাদার্স ইন্টারন্যাশনাল নামে যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন তার স্বত্বাধিকারী আব্দুল মান্নান খোকন।
তিনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র (২৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর) আব্দুস সবুর লিটনের আপন ভাই। নকল ব্যান্ডরোল আমদানিকারক বাপ্পু এন্টারপ্রাইজ, আরাফাত এন্টারপ্রাইজ ও ব্রাদার্স ইন্টারন্যাশনালের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পর্যালোচনা করে তাদের (লিটন ও খোকন) লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়।
মূলত খোকন এ অবৈধ ব্যান্ডরোল আমদানির সঙ্গে সরাসরি জড়িত এবং এর পৃষ্ঠপোষকতা করেন প্যানেল মেয়র লিটন। এছাড়া তার গ্রুপের ব্যবসায়িক পার্টনার মেজবাহ উদ্দিন হায়দারও নকল ব্যান্ডরোল আমদানিতে সম্পৃক্ত।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ব্যবসায়িক সূত্রে প্যানেল মেয়র লিটন ‘তারা গ্রুপ’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। কিশোরগঞ্জের ভৈরবে তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো এবং কক্সবাজারের চকরিয়ায় বিজয় ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো নামে দুটি সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে লিটনের। বিজয় টোব্যাকোতে মেয়রের ভাই খোকনের শেয়ার রয়েছে।
প্রসঙ্গত, তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকোর বিরুদ্ধে এর আগেও নকল ব্যান্ডরোল ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাপ্পু এন্টারপ্রাইজ ও আরাফাত এন্টারপ্রাইজের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, আমদানি, রপ্তানি কার্যক্রম ব্রাদার্স ইন্টারন্যাশনাল ও তারা গ্রুপ পরিচালনা করত।
এভাবে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক হিসাব খোলা, এলসি খুলে কাগজ ও আর্ট পেপার আমদানির নামে নকল ব্যান্ডরোল আমদানিতে জড়িত চক্রকে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে ব্যাংক ম্যানেজার এবং অ্যাকাউন্ট খোলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্যানেল মেয়র আব্দুস সবুর লিটন যুগান্তরকে বলেন, ‘এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। যারা এ রিপোর্ট দিয়েছে তারা কোথা থেকে এমন তথ্য পেল, সেটা তাদেরই জিজ্ঞাসা করেন।’
অপরদিকে নকল ব্যান্ডরোল ব্যবহারের বিষয়ে তিনি দাবি করেন, ‘অনেক ছোট প্রতিষ্ঠান আছে যারা বড় কোম্পানির সিগারেট নকল করে বাজারে বিক্রি করছে। এ চক্রটি হয়তো একইভাবে আমার ব্র্যান্ডের সিগারেটও নকল করেছে।’
আব্দুল মান্নান খোকন বলেন, ‘আরাফাত আমার কর্মচারী ছিল না। আমি ওর কাছ থেকে কিছু মাল কিনেছিলাম। সেই টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়েছে। সে কোথায় থাকে, কী করে-না-করে আমি এসবের কিছু জানি না।’
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম কাস্টমসে নকল ব্যান্ডরোল জব্দের পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নির্দেশে তদন্ত শুরু করে ভ্যাট গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।
দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মোট ১০টি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনকৃত ২৮ ব্র্যান্ডের সিগারেট সংগ্রহ করে সেগুলোর ব্যান্ডরোল যাচাইয়ের জন্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনে পাঠায় সংস্থাটি।
এরপর সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের তথ্যের ভিত্তিতে গত ৫ জানুয়ারি এনবিআরে ভ্যাট গোয়েন্দায় একটি প্রতিবেদন পাঠায়। ভ্যাট গোয়েন্দার প্রতিবেদনে বলা হয়, ৭টি ব্র্যান্ডের সিগারেটে নকল ব্যান্ডরোল ব্যবহার করা হয়েছে।
এগুলো হলো-তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকোর জেট ও পিকক, হেরিটেজ টোব্যাকোর গুরু, ভার্গো টোব্যাকোর পার্টনার, দেশ গোল্ড, ভার্জিন এবং মিরাজ টোব্যাকোর সেনর গোল্ড।
এছাড়া ৪টি ব্র্যান্ডের সিগারেটের ব্যান্ডরোল পুনঃব্যবহার করা হয়েছে। এগুলো হলো-হেরিটেজ টোব্যাকোর সিটি গোল্ড ও গুরু, ওয়ান সিগারেট ফ্যাক্টরি বাংলাদেশের রিজেন্ট ও টপ ১০।
এ বিষয়ে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন। সে জনপ্রতিনিধিই হোক বা সাধারণ ব্যবসায়ী।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে যদি জনপ্রতিনিধির সম্পৃক্ততা উঠে আসে, তবে দেশের প্রচলিত আইনে বিচার হওয়া উচিত। শুল্কসংক্রান্ত অপরাধ করলে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। ফৌজদারি অপরাধ করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নেবে। দুদকও এক্ষেত্রে বিস্তারিত তদন্ত করতে পারে।’
রপ্তানির মাধ্যমে নগদ সহায়তা আত্মসাৎ : গোয়েন্দা প্রতিবেদন বলা হয়েছে, অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে রপ্তানি না করে কিংবা কম রপ্তানি করে নগদ সহায়তা নেওয়ার ঘটনাও ঘটছে।
বিশেষ করে মসলা, খাদ্য ও কৃষিজ পণ্য রপ্তানিতে বেশি সহায়তা দেওয়ায় এ ধরনের পণ্য রপ্তানিতে বেশি অনিয়ম হয়ে থাকে।
এক্ষেত্রে কাস্টমস, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও নিরীক্ষা ফার্মসহ বিভিন্ন দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের যোগসাজশ কিংবা দায়িত্বে অবহেলার সুযোগে এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে।
জালিয়াতি বন্ধে ৬ সুপারিশ : গোয়েন্দা প্রতিবেদনে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি, রপ্তানির বিপরীতে নগদ সহায়তা জালিয়াতি বন্ধে ৬টি সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে কঠোর নির্দেশ দিতে হবে।
এক্ষেত্রে কেওয়াইসি ফর্ম পূরণ বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। কিন্তু কারও দায়িত্বে অবহেলা কিংবা অসততার প্রমাণ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, এলসি খোলার সময় আমদানিকারক-রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঠিক তথ্য জানা এবং ক্রেডিট রেটিং নেওয়া, পণ্যের সঠিক মূল্য নিশ্চিত হওয়ার পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে।
তৃতীয়ত, কোনো প্রতিষ্ঠানের নামে ট্রেড লাইসেন্স, বিআইএন, আইআরসি-ইআরসি সনদ দেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে আবেদন সঠিকভাবে যাচাই করে সনদ দেওয়া যেতে পারে।
চতুর্থত, শুল্ক ফাঁকি বা অর্থ পাচার এবং ভুয়া রপ্তানির মাধ্যমে নগদ সহায়তা গ্রহণে জড়িত ব্যক্তি এবং এই অপকর্মে সহযোগিতাকারী ব্যাংক ও অন্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
পঞ্চম, এ ধরনের অপকর্মে জড়িত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের নিবন্ধন বাতিল করা যেতে পারে। পরবর্তী সময়ে এসব অসাধু চক্র যাতে নতুন নামে নিবন্ধন নিতে না পারে, সেজন্য তাদের কালো তালিকাভুক্ত করা।
ষষ্ঠ, মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি-রপ্তানি বন্ধে আমদানিকারক ও রপ্তানিকারক দেশের কাস্টমস কর্তৃপক্ষ একে অপরের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে।