তানভীর আহমেদ, তাহিরপুর:
‘একপাশে পাহাড় আর অন্যদিকে হাওরের বুকে সবুজের হাতছানিতে সৌন্দর্যের ডালপালা ছড়িয়ে দাড়িয়ে আছে হিজল-করচ গাছ। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও ধরমপাশা উপজেলার চার ইউনিয়নের ১৮ মৌজা নেয় টাঙ্গুয়া হাওরের আয়তন প্রায় ১২ হাজার ৬৫৫ হেক্টর। টাঙ্গুয়া হাওর দেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট। এ হাওর কে বলা হয় দেশি মাছের আধার বা ‘মাদার ফিশারিজ’। তবে বর্তমানে টাঙ্গুয়া হাওরের জীব বৈচিত্র্য হুমকির মূখে রয়েছে। উজাড় হচ্ছে টাঙ্গুয়া হাওরের হিজল-করচ গাছ। এছাড়াও হাওরের পানিতে প্লাস্টিক ও পলিথিনের মতো বর্জ্য ফেলায় ক্ষতিগ্রস্তের শিকার হচ্ছে হাওরের মাছ গুলো। হাওরের সুরক্ষা ও জীববৈচিত্র রক্ষায় প্রশাসনের কঠোর নজরদারী এখন স্থানীয়দের সময়ের দাবী’।
‘স্থানীয়দের অভিযোগ, হাওরে ৪টি আনসার ক্যাম্প (মুজরাই, গোলাবাড়ি, রামসিংহপুর, রংসী) থাকলেও সংশ্লিষ্টরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না। এতে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে একটি অসাধু চক্র। অভিযোগ, হাওর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা কমিউনিটি গার্ডের সদস্য, ম্যাজিস্ট্রেটের নৌকার মাঝি সহ স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠনের নাম ব্যবহার করে কৌশলে রাতের আধারে চক্রদের অনিয়মে সহযোগিতা করেন তারা। ফলে গত কয়েক বছর ধরে প্রায়ই হাওরের গাছ কেটে সাবাড় করছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র’।
‘উল্লেখ্য, গত (২৭ অক্টোবর, বুধবার) রাতে অজ্ঞাত নামক দুর্বৃত্তরা টাঙ্গুয়া হাওরে বিভিন্ন অংশের ছোটবড় বাগানের বেশ কিছু হিজল-করচ গাছ কেটে নিয়ে যায়। পরে তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ রায়হান কবির ও শ্রীপুর (দক্ষিণ) ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ সরকার সরেজমিন টাঙ্গুয়া হাওর পরিদর্শন করেন’।
‘স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, শুধু হাওরের গাছ নয় প্রতিবছর শীত মৌসুমে সুদূর সাইবেরীয় সহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অতিতি পাখিও রেহাই পায় না অসাধু প্রকৃতির শিকারির হাত থেকে। টাকা দিলেই অতিতি পাখি মিলে খাবারের প্লেইটে। গোপনে পাওয়া যায় বিভিন্ন বাজারেও। আর প্রতিবছর এভাবে অতিতি পাখি শিকার করায় অতিতি পাখির আগমন বছরের পর বছর কমে আসছে। চলতি বছরে অতিতি পাখি আগমনের সময়ও প্রায় ঘনিয়ে আসছে, টাঙ্গুয়া হাওর কে অতিতি পাখিদের নিরাপত্তার আশ্রয়স্থল হিসেবে ঘরে তুলতে প্রশাসনের কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা করার দাবী স্থানীয়দের’।
বৃক্ষপ্রেমিক আব্দুল আমীন বলেন, গাছ আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ। গাছ রক্ষা করার দায়িত্ব শুধু প্রশাসনের নয়, আমাদেরও। এভাবে হাওরের গাছ গুলো কাটা হলে একদিন হয়তো আর হাওরে কোনো গাছ থাকবে না। তাই ‘সবাই মিলে ঐক্য গড়ি, টাঙ্গুয়া হাওরের প্রাণ রক্ষা করি’।
তাহিরপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রায়হান কবির জানান, গত সাপ্তাহে দুর্বৃত্তরা কিছু গাছ কেটেছে, খবর পেয়ে সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করি। অভিযোক্তদের ধরতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি আমরা। আর অতিতি পাখিদের নিরাপত্তার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানকে নিয়ে মিটিং করেছি। হাওরে কমিউনিটি গার্ড সদস্যরাও সক্রিয় থাকবে। তারা যদি কোনো অনিয়ম করে, আর সেই খবর আমরা পাই তাহলে তাদের বিরোদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিতি পাখি শিকার বন্ধে টাঙ্গুয়া হাওরের আশপাশ এলাকায় সচেতনতা মূলক মাইকিং করা হবে। তার পরেও যদি কোনো দুষ্কৃতি চক্র পাখি শিকারের চেষ্টা চালায় তাহলে সাথে সাথে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
উল্লেখ্য, টাঙ্গুয়া হাওরে আশির দশকে তাহিরপুরের জয়নাল আবেদিন নামক এক বৃক্ষপ্রেমিক সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে প্রায় এক লাখ হিজল-করচ চারা লাগিয়েছিলেন। আবার তিনিই শিমুল গাছও রোপণ করে ঘরে তুলেছেন দেশের বৃহত্তম শিমুল বাগান। টাঙ্গুয়ায় জয়নাল আবেদিনের লাগানো হিজল-করচের চারাগুলোই এখন দৃষ্টিনন্দন বাগানে রূপ নিয়েছে। তবে প্রাকৃতিকভাবেও জন্ম নিয়েছে অনেক গাছ। এসব গাছ কেটে হাওরের সৌন্দর্য নষ্ট করার বিষয়টি প্রশাসন কঠোরভাবে দমন করলে একদিকে রক্ষা পাবে হাওরের গাছগুলো অপরদিকে দৃষ্টি নন্দন রূপে প্রাণ ফিরবে প্রকৃতির এমনেই মনে করছেন স্থানীয় প্রকৃতি প্রেমিরা।