একসময় বই শুধু জ্ঞানের মাধ্যম ছিল না, বই ছিল আবেগের অংশ, ছিল এক ব্যক্তিগত শান্তির ঠিকানা। নতুন বইয়ের মোড়ক খুলতেই যে কাগজের গন্ধ উঠে আসত, তা যেন পাঠকের মনকে ছুঁয়ে দিত অন্য এক জগতে। বইয়ের পাতায় হাত বুলিয়ে গল্পের মধ্যে ডুবে যাওয়ার আনন্দই ছিল আলাদা। সেই সময় মানুষ বইয়ের পাতা ওল্টানোকে শুধু অভ্যাস হিসেবে নয়, বরং জীবনের একটি সুন্দর অংশ হিসেবেই দেখত। কিন্তু সময় ক্রমেই বদলে যাচ্ছে।
আধুনিক প্রযুক্তির উত্থান আমাদের জীবনকে যত সহজ করেছে, ততই বদলে দিয়েছে আমাদের পাঠ-সংস্কৃতি। এখন বইয়ের জায়গা দখল করেছে মোবাইল, ট্যাব ও ল্যাপটপের ঝকঝকে স্ক্রিন। ই-বুক, পিডিএফ আর অডিওবুকের সহজলভ্যতা বইকে অনেকটাই সরিয়ে দিয়েছে মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহার থেকে। জ্ঞান এখন আর লাইব্রেরি বা বইয়ের দোকানে নয়, বরং একটি টাচস্ক্রিনে সহজেই পাওয়া যায়। তবে এই পরিবর্তনের মধ্যেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমরা ধীরে ধীরে ভুলে যাচ্ছি। বই হাতে নেওয়ার অনুভূতি, কাগজের উষ্ণতা, নিজের হাতে বুকমার্ক রাখা কিংবা প্রিয় লাইন আন্ডারলাইন করে রাখা এসবের কোনো বিকল্প নেই। এই অনুভূতি প্রযুক্তির স্ক্রিনে কখনোই পাওয়া যায় না।
বর্তমান তরুণ সমাজ বই পড়ার চেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় কাটাতেই বেশি আগ্রহী। ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম বা টিকটক এসব প্ল্যাটফর্ম তাদের জীবনের বড় একটি অংশ দখল করে নিয়েছে। জ্ঞানার্জনের চেয়ে বিনোদনের পেছনেই এখন ব্যয় হচ্ছে তাদের মূল্যবান সময়। প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে সহজ করলেও, মোবাইল স্ক্রিন ধীরে ধীরে কেটে নিচ্ছে আমাদের মনোযোগ, সৃজনশীলতা ও চিন্তার গভীরতা। এটির প্রভাব স্পষ্ট। বেড়ে যাচ্ছে শারীরিক ও মানসিক সমস্যা চোখের দুর্বলতা, মাথাব্যথা, ঘুমের ব্যাঘাত, মনোযোগের ঘাটতি, এমনকি মানসিক চাপও।
অতিরিক্ত স্ক্রিন-নির্ভরতা যুবসমাজকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অগভীরতায়, যেখানে তথ্যের প্রাচুর্য আছে, কিন্তু জ্ঞানার্জনের গভীরতা কমে যাচ্ছে। প্রযুক্তি নিঃসন্দেহে জ্ঞানের দরজা খুলেছে যেকোনো তথ্য এখন মুহূর্তেই পাওয়া যায়। তবে বইপড়া যে ধীরস্থির মনোযোগ শেখাত, যে গভীর চিন্তার অভ্যাস গড়ে তুলত, প্রযুক্তি সেই জায়গাটিই নষ্ট করে দিচ্ছে। বই পড়ার সময় পাঠক এক ধরনের নির্জনতা খুঁজে পায়, যা মনকে শান্ত করে। কিন্তু স্ক্রিনে পড়ে মন বিভ্রান্তির মধ্যেই থাকে একনাগাড়ে নোটিফিকেশন, বিজ্ঞাপন, দ্রুততর বিনোদনের চাপ। তবুও সব হারিয়ে যায়নি।
এখনও অনেকেই বইয়ের পাতায় ডুব দিয়ে নিজের সুখ খুঁজে পান। বইয়ের গন্ধ, পাতার শব্দ, প্রিন্টের উষ্ণতা এসব অনুভূতি তরুণ সমাজের কাছে নতুন করে ফিরে আসতে পারে, যদি আমরা একটু চেষ্টা করি। কারণ বই শুধুই কাগজ নয়, বই হলো চিন্তার আলো। আজকের দিনে বই যেন হয়ে গেছে স্মৃতির অংশ নস্টালজিয়ায়। কিন্তু সেই নস্টালজিয়া আবার ফিরে আসতে পারে, যদি আমরা চাই। যদি আমরা সত্যিই বুঝতে পারি বইয়ের আলো কখনোই স্ক্রিনের আলো দিয়ে পুরোপুরি মুছে দেওয়া যায় না।
