এনামূল হক পলাশ: আজ ১৮ আগস্ট। যতীন স্যারের ৯০। ঠিক চার দিন আগে যতীন স্যার আমাদেরকে রেখে অনন্তের পথে যাত্রা করেছেন।
আমি অধ্যাপক যতীন সরকারকে যতীন স্যার হিসেবে বলছি এই কারণেই যে, তিনি আমাদের সময়ের একজন শিক্ষক এবং আমাদের সময়ে আমরা শিক্ষকদেরকে স্যার হিসেবেই জানি। তিনি তথাকথিত প্রভু মানসিকতার কর্তৃত্ববাদী স্যার নন, বরং তিনি আমাদের গুরু। তিনি আমাদেরকে পথ দেখান। আমরা যা চিন্তা করতে পারিনা সেই চিন্তা আমাদের ভেতরে ঢুকিয়ে দিতেন। এই বিষয়ে ব্রাজিলীয় ঔপন্যাসিক এবং গীতিকার পাওলো কোয়েলহোর ‘বাবা, ছেলে আর নাতিদের জন্য গল্প’ থেকে একটি গল্প কোট করতে চাই। গল্পটি হচ্ছে, “যোগী রমন ছিলেন ধনুর্বিদ্যা শিল্পের একজন প্রকৃত গুরু। একদিন সকালে তিনি তার প্রিয় শিষ্যকে নিজের দক্ষতা প্রদর্শন করতে আমন্ত্রণ জানান।
শিষ্যটি এর আগে এটি একশো বারেরও বেশি দেখেছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও সে তার গুরুকে মান্য করতো।
তারা আশ্রমের পাশে অরণ্যে ঢুকে গেল। তারপর তারা একটি চমৎকার ওক গাছের কাছে পৌঁছেছিল। রমন তার মাফলারের ভেতরে গুঁজে রাখা একটা গোলাপ ফুল বের করে ওক গাছেটার একটা ডালে স্থাপন করলেন।
তারপর তিনি ব্যাগ খুলে তিনটি জিনিস বের করলেন: মূল্যবান কাঠ দিয়ে তৈরি নিজের চমৎকার ধনুক, একটি তীর আর সূচ দিয়ে লাইলাকের কাজ করা একটি সাদা রুমাল।
যোগী ফুলটি যেখানে স্থাপন করেছিলেন সেখান থেকে একশত পা দূরে অবস্থান করলেন। লক্ষ্যের মুখোমুখি হয়ে তিনি শিষ্যকে রুমাল দিয়ে তার চোখ বেঁধে দিতে বললেন।
শিষ্য তার গুরুর কথা অনুযায়ী কাজটি করল।
‘তুমি আমাকে কতবার ধনুর্বিদ্যার মহৎ ও প্রাচীন খেলার অনুশীলন করতে দেখেছ?’ রমন তাকে জিজ্ঞেস করলেন।
‘প্রতিদিন,’ তার শিষ্য উত্তর দিল। ‘আর আপনি সবসময় তিনশ পা দূরে থেকে গোলাপকে আঘাত করতে পেরেছেন।’
রুমাল দিয়ে চোখ ঢেকে যোগী রমন তার পা মাটিতে দৃঢ়ভাবে রাখলেন। তার সমস্ত শক্তি দিয়ে ধনুকের জ্যা টানলেন – ওক গাছের একটি ডালে রাখা গোলাপের দিকে লক্ষ্য করলেন – আর তারপর তীরটি ছেড়ে দিলেন।
তীরটি বাতাসে শিস দিয়ে উঠলো, কিন্তু এটি গাছে আঘাত করেনি। তীরটি লজ্জাজনক ব্যবধানে লক্ষ্য হারিয়েছে।
‘আমি কি লক্ষ্যে আঘাত করেছি?’ চোখ থেকে রুমাল সরিয়ে বললেন রমন।
‘না, আপনি পুরোপুরি মিস করেছেন,’ শিষ্য উত্তর দিল। ‘আমি ভেবেছিলাম আপনি আমাকে চিন্তার শক্তি এবং জাদুকরী ক্ষমতা প্রদর্শন করতে যাচ্ছেন।’
‘আমি তোমাকে চিন্তার শক্তি সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ শিখিয়েছি,’ রমন উত্তর দিলেন। ‘যখন তুমি কিছু চাও শুধুমাত্র তাতেই মনোনিবেশ করো: কখনও এমন লক্ষ্যে আঘাত করো না যা তুমি দেখতে পাও না।’
আমরা যতীন স্যারের জ্ঞানাশ্রমে যারা নিয়মিত ঢু মারতাম তারা তার অনুশীলন সম্পর্কে জানি। কিন্তু সবসময় একই পাঠ নিয়ে ঘরে ফিরি না। প্রায় নিয়মিত যতীন স্যারকে পাঠ করতাম, তাতে কখনো বিরক্ত হই নি। তার চিন্তা এবং দর্শন প্রতিদিন আমাদের কাছে নতুন ভাবে ধরা দিত। যোগী রমনের মতো তিনি তার নিত্য শিষ্যদের নিত্যনতুন চিন্তা দান করে গেছেন।
যতীন সরকার শুধুমাত্র আমাদের শিক্ষকই নন, তিনি এই সময়ের শিক্ষক ছিলেন। তিনি জানিয়ে গেছেন, মাস্টারি করতে গিয়ে ক্লাসরুমে ৪৫ মিনিট সময়ের মধ্যে প্রতিটি ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদেরকে শুধুমাত্র পাঠদান করে গেলেও ক্লাসরুমে পাঠদানের বাইরে তার নিজস্ব চিন্তা, দর্শন, চেতনাকে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে প্রকাশ করতে পারেননি। সেই চিন্তাগুলি প্রকাশের জন্য তিনি মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন বক্তৃতা এবং লেখালেখি। যতীন সরকার এমনই একজন মানুষ যিনি অসাধারণ বাগ্মিতার জন্য সারাদেশেই জনপ্রিয় চিন্তক। তার ভাষা অত্যন্ত সরল যার মধ্যে কোন মারপ্যাঁচ নেই। তিনি সহজ এবং সরল ভাষায় কঠিন কথাটি বলে দিতে পারতেন।
তিনি সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রত্যাশা ব্যক্ত করতেন। এই প্রত্যাশার মধ্যে গভীর একটি প্রশ্ন লুকায়িত আছে। তাহলে কি সংস্কৃতি এখন ঘুমিয়ে আছে? এই প্রশ্নের উত্তর তিনি দিয়েছেন অবলীলায় সাংস্কৃতিক দৈন্যতাকে স্বীকার করে নিয়ে। তিনি লিখেছেন, “সমাজের স্বাভাবিক চর্চা, শিক্ষা ও মানবিক উন্নয়নের যতগুলো পথ আছে, সবই বিচ্ছিন্ন থেকে আরও বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সেগুলোকে একত্রিত করে মানবিক মূল্যবোধ ও জীবনবীক্ষার দিকে নিয়ে যেতে আমরা পারছি না। কারণ স্বাধীনতার মূল্যবোধের কথা আমরা শুধু মুখে বলি; কিন্তু স্বাধীনতার মূল্যবোধ আমরা ভুলে গেছি, এমনকি তা থেকে অনেক দূরে সরে গেছি। স্বাধীনতার সংগ্রামে যে দল নেতৃত্ব দিয়েছে, সেই দল ক্ষমতায় আসার পরও তা হয়নি। কারণ যেভাবে দলটি চলার কথা ছিল, সেভাবে চলতে পারেনি।”
বিশাল এক সময় জুড়ে বাংলাদেশে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা অনুপস্থিত। মানুষের ভেতর রাজনৈতিক চেতনা নেই। এই সময়ের ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করলে যতীন সরকারের এই কথাটি প্রাসংগিক হিসেবে ধরা দেয় আমাদের মাঝে। যতীন সরকারের চিন্তা সবসময়ই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে ধারণ করে অগ্রসর হয়। তিনি বিশ্লেষণ করেন দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে। অথচ কী সহজ এবং সরল বয়ানে তিনি অবলীলায় নিজের চিন্তাকে প্রকাশ করতে পারেন। এই বিষয়টি যতীন সরকারকে অন্যান্য চিন্তকদের থেকে আলাদা করেছে।
তিনি মনে করতেনন মানুষের সার্বিক মুক্তির লড়াই হচ্ছে প্রকৃত লড়াই। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মধ্যে লুকায়িত আছে উন্নত মানুষের সভ্যতার চাবিকাঠি। তিনি ভারতীয় সাধু বা সুফির দর্শনের বিজ্ঞান ভিত্তিক রূপের প্রতিচ্ছবি। জীবনকে ব্যখ্যা করেন বস্তুবাদী দৃষ্টিতে। সাধু সন্তুর সাথে হয়তো বস্তুবাদ যায় না, কিন্তু যতীন স্যার আপাদমস্তক একজন সাম্প্রয়িকতাবিরোধী চেতনার একজন মানুষ। তাকে অসাম্প্রদায়িক বলা যাবেনা, কারণ তিনি তার জীবন দর্শন এবং লেখায় অন্যান্য বস্তুবাদীদের মতো সম্প্রদায়কে অস্বীকার করেন নি। সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব স্বীকার করে ঘৃন্য সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদকে অস্বীকার করেছেন। এখানেই একজন যতীন সরকারের বিশেষত্ব।
বাংলার নবজাগরণ যাকে বাঙালি রেনেসাঁও বলা হয়, ব্রিটিশ রাজের বঙ্গীয় অঞ্চলের একটি উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক, সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং শৈল্পিক আন্দোলন ছিল, যা ১৮ শতকের শেষ থেকে ২০ শতকের প্রথম দিকে বিস্তৃত হয়। এই সময়ে বিভিন্ন সমাজ reformer এবং সাহিত্যিকরা সমাজের অন্ধকার দিকগুলোকে তুলে ধরেন এবং নতুন চিন্তাধারার প্রচার করেন। রাজা রামমোহন রায়কে এর জনক বলা হয়।
আমাদের যতীন স্যার ছিলেন সেই ধারায় যে মহাগ্রন্থটি রচিত হয়েছে তার সর্বশেষ অধ্যায়।
সংস্কৃতি জাগরণের দুটি মহাগ্রন্থ আমরা পাঠ করি। এর একটি হচ্ছে রামমোহন রায় প্রবর্তিত চিন্তাধারা। এর বিপরীত ধারার যে মহাগ্রন্থটি আছে তা লেখা এখনো চলমান আছে।
আমাদের কাজ হচ্ছে দুইটি মহাগ্রন্থ একত্রিত করে একটি ঐক্যের সংস্কৃতি চালু করা। স্যারের ৯০ তম জন্মদিনে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। যতীন সরকারের প্রয়াণের শোক হবে আমাদের সামনে যাওয়ার শক্তি।