এনামূল হক পলাশ: মওলানা ভাসানী সহ সকল জননেতারা পূর্ব বাংলার মানুষের জন্য একটা ঐক্যের জায়গা তৈরি করতে চাইছিলেন। এজন্য তারা বেছে নিয়েছিলেন একজন শেখ মুজিবুর রহমানকে। শেখ মজিবুর রহমান তখন পাকিস্তানের জালেম শাসকদের দ্বারা কারানির্যাতিত মজলুম নেতা যিনি পূর্ব বাংলার মানুষের পক্ষে কথা বলেন। ১৯৬৯ সালে ভাসানীর নেতৃত্বে গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আপামর জনতা শেখ মুজিবকে কারামুক্ত করে। সেই সময়, ঐতিহাসিক প্রয়োজনে নির্মান করা হয় একজন বঙ্গবন্ধুকে। এই নির্মান আমাদেরকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ রাখে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠা পায়। মওলানা ভাসানী নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে পূর্ব বাংলার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে সাহায্য করেন। সেই আমল ছিল এমন এক আমল যে আমলে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন আর শোষণ থেকে মুক্তির প্রশ্নে পূর্ব বাংলার মানুষের মধ্যে কোন বিভাজন ছিল না। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমান ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। গ্রেফতারকৃত শেখ মুজিব জনতার আড়ালে গিয়ে এক মিথে পরিণত হন। সেই মিথের উপর ভিত্তি করেই পরবর্তী ঘটনাবলী বিকশিত হতে থাকে।
১৯৭১ সালের ২৫ পঁচিশে মার্চ পাকিস্তান সরকার অপারেশন সার্চলাইটের নামে পূর্ব বাংলায় গণহত্যা চালায়। এসময় প্রায় সকল রাজনৈতিক নেতা আত্মগোপনে চলে যান। ২৭ মার্চ ইতিহাসের দৃশ্যপটে আবির্ভূত হন জিয়াউর রহমান নামের একজন মেজর। তাকে পাঠানো হয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর থেকে অস্ত্র খালাস করার জন্য। সে এক দারুণ সংকটময় মুহূর্ত। মেজর জিয়ার কাছে খবর আসে, বাঙালি অফিসারদেরকে হত্যা করা হবে। সামনে মৃত্যু, পেছনে কোর্ট মার্শাল।
তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি রিভল্ট করেন। ২৭ মার্চ তিনি দেশ ও জাতির পক্ষে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ এবং রাজনৈতিক সরকার গঠনের প্রেক্ষাপট। দলে দলে লোক ঝাপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে।
পরবর্তীতে শেখ মুজিবুর রহমান এবং জিয়াউর রহমান উভয়েই স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন এবং জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল পূর্ব বাংলার জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বয়ান নিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পরিপূর্ণ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে আবির্ভূত হয়।
ঢাকা সেনানিবাসের একটি বড় রেসিডেন্সে, শহীদ মঈনুল রোডের ৬ নম্বর বাড়িতে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাস করতেন। আসলে এটি ছিল সেনা প্রধানের (Deputy Chief of Staff) সরকারি বাসভবন—জিয়াউর রহমান সেই পদে ছিলেন এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও তিনি এখানেই থাকতেন ।
১৯৮১ সালের ৩০শে মে চট্টগ্রামে ঘটানো রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর যুগ্ম রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার এই বাসভবনটি প্রতীকী মূল্যে (কাজটি রাষ্ট্রপতির এখতিয়ারে আছে এবং আইনসম্মত) মূল্যে বরাদ্দ দেন বেগম খালেদা জিয়া ও তাঁদের দুই সন্তানের নামে। ২০১০ সাল পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়া এখানেই বসবাস করতেন। সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা প্রয়োগ করে সরকারি লোক ব্যবহার করে ১৩ নভেম্বর ঢাকা সেনানিবাসের বাসা থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদ করেন। সরকারি লোকজন স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন মহান যোদ্ধার স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটিতে ভাংচুর চালান।
ক্ষমতার জোরে ঐতিহাসিক এই বাড়িটি থেকে বেগম খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদের পর, মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস (MES) ওই বাড়িটি দ্রুত ধ্বংস করে ফেলে । কিছু দিনের মধ্যেই সেখানে ফাঁকা মাঠ দেখা যায়। পরবর্তীতে সেই জায়গায় ৫টি বহুতল আবাসন নির্মাণ করা হয়—যেগুলোর নাম “আরশি”, “পরশি”, “গাগরি”, “বিহঙ্গ” ও “আগামী”। এগুলোর মধ্যে “আরশি” ও “পরশি” লেফটেন্যান্ট কর্নেলদের জন্য এবং “গাগরি”, “বিহঙ্গ”, “আগামী” মেজর পদমর্যাদার সেনা কর্মকর্তাদের জন্য নির্মিত হয়। এর পাশাপাশি সেখানে মসজিদ, প্লেগ্রাউন্ড ইত্যাদি সহায়তামূলক স্থাপনাও নির্মিত হয়েছে ।
১৯৫৬ সালে পাকিস্তানে কোয়ালিশন সরকার গঠন হলে সরকারের চীফ মিনিস্টার নির্বাচিত হন আতাউর রহমান খান। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সেই মন্ত্রী সভার বাণিজ্য, শ্রম, শিল্প ও দুনীর্তিদমনমন্ত্রী। সেই সময় ১৯৫৭ সালের শুরুতে বেগম মুজিবের নামে ধানমন্ডিতে ৬ হাজার টাকা মূল্যে কিস্তিতে ১ বিঘার একটি প্লট বরাদ্ধ দেয়া হয়। সেখানে গড়ে উঠা বাড়িটি আজকের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এই বাড়িটিতে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। তার ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে। তারপর ২০০৯ সালে আবার শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেন এবং প্রতিহিংসার রাজনীতিতে লিপ্ত হন। শেখ হাসিনা তার নেতৃত্বে একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন। তিনি দেশে ভয় ও জুলুমের রাজত্ব তৈরি করেন। ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে গণ অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পলায়ন করেন।
শেখ হাসিনার পতনের পর উত্তেজিত জনতা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ৩২ নম্বর বাড়িটির আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত করে। পরে ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে ধারাবাহিক ঘটনায় সাধারণ জনতা এটি সম্পূর্ণরূপে ভেঙে ফেলে।
ক্ষমতার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জিয়াউর রহমানের বাড়িটা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন। তখন হয়তো কারোরই কিছু করার ছিল না। একই ঘটনা ফিরে এসেছে তার মাত্র ১৪ বছর পর। উত্তেজিত জনতা প্রবল পরাক্রমশালী শেখ হাসিনার বাড়ি গুড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু কেউ কিছু করতে পারে নি। প্রতিহিংসা এমনই এক বিষয় যা নিজের উপর যখন পতিত হয় তখনই এর গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়।
শেখ হাসিনা নিজে ত পালিয়ে গেলেনই, সাথে করে বাংলার ইতিহাসে তার পিতাকেও বিতর্কিত করে গেলেন।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা অবদান রেখেছেন আমরা তাদেরকে শ্রদ্ধার জায়গায় রাখতে চাই। বাংলাদেশের ধারাবাহিক ইতিহাস নির্মাণ করতে হলে সবাইকে আমাদের প্রয়োজন। প্রতিটি মানুষই ইতিহাসের এক একটি চরিত্র।
এটি ভবিষ্যতের জন্য একটি বার্তা। ১৯৭১ সালে যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন বা ২০২৪ সালে সালে যারা অভ্যুত্থানে ছিলেন তারা অবশ্যই বিষয়টি বিবেচনায় নিবেন। কখনো কর্তৃত্ববাদ কায়েম করার চেষ্টা করবেন না। কখনো ক্ষমতা দেখাবেন না। জনতাই চূড়ান্ত ক্ষমতা।
লেখক : কবি ও ভাবুক।