রংপুর প্রতিনিধিঃ
সমাজে মব জাস্টিসের ভয়াবহ ছায়া আবারও দেখা দিয়েছে। গতকাল শনিবার (১০ আগষ্ট) রাত ৯ টায় রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের বুড়িরহাট বাজার এলাকার বটতলায় চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে ১ জন নিহত এবং অপরজন গুরুতর আহত হয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিহিত হয় । নিহত ব্যক্তিরা হল বাড়ি তারাগঞ্জ উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরমপুর মেডিকেল এলাকার রূপলাল (৪২)।
অপরজন প্রদীপ (৩৫) তার সম্পর্কের জামাই, যার বাড়ি মিঠাপুকুর উপজেলার গোপালপুর ছড়ান বালুয়া এলাকায়। এই ঘটনা মাদকদ্রব্যকে কেন্দ্র করে মিথ্যা অপপ্রচারের ফলস্বরূপ ঘটেছে । জানা যায়, রূপলাল এবং প্রদীপ পার্শ্ববর্তী বদরগঞ্জ উপজেলায় বাংলা চোলাই মদ খেয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। তাদের সঙ্গে কয়েকটি প্লাস্টিকের বোতলে কয়েক লিটার মদ ছিল। বটতলা এলাকায় পৌঁছানোর পর স্থানীয় কিছু লোক মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে দেয় যে তারা চোর। এতে উৎসুক জনতার ভিড় জমে যায় এবং তারা দুজনকে নির্মমভাবে পেটাতে শুরু করে।
“হাজারবার বাঁচার আকুতি করেও রক্ষা পাননি তারা,” বলে জানিয়েছেন এক প্রত্যক্ষদর্শী । নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বুড়িরহাট এলাকার মেহেদী নামের এক যুবকের অতি বারবাড়ি, ফেসবুক লাইভ, মাদক বোতল খুলে শুকে অজ্ঞান হওয়ার অভিনয়ের কারণে জনতা ফুঁসে ওঠে। মাদকের বিষয়টি নিয়ে দ্রুত গুজব ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু কেউ তাদের কথা না শুনে ঘটনাস্থলে রূপলালকে পিটিয়ে হত্যা করেছে ও প্রদীপকে পিটিয়ে আধমরা করেছে । পরে উন্মত্ত জনতা ২ জনকেই বুড়িরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে নিয়ে গিয়ে ফেলে রাখে ।
ঘটনাস্থলে পৌঁছে তারাগঞ্জ থানার পুলিশ ও তারাগঞ্জ আর্মি ক্যাম্প দল দুজনকে উদ্ধার করে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক রূপলালকে মৃত ঘোষণা করেন। প্রদীপের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, প্রদীপের মাথা, মুখ , বুক এবং পায়ে গুরুতর আঘাত রয়েছে, এবং তার জীবন সংশয়াপন্ন । আজকে সেও মৃত্যু বরণ করে। নিহত রূপলালের পরিবারে শোকের ছায়া নেমেছে। তার স্ত্রী ভারতী আহাজারি করে বলেন, “তারা বাড়ি ফিরছিল, কিন্তু এমন অমানবিক নির্যাতন করে স্বামী ও জামাইকে হত্যা করেছে ! আমরা ন্যায়বিচার চাই।”
এলাকাবাসী জানায়, রূপলাল পেশায় একজন মুচি ছিল। সে তারাগঞ্জ হাটে ফুটপাতে বসে মানুষের জুতা স্যান্ডেল -সেলাই করে দিনযাপন করত । সম্প্রতি মেয়ে নূপুরের বিয়ের আলাপ আলোচনা চলছিল । সেজন্যেই ভ্যানচালক জামাই প্রদীপকে ডেকেছিল । কিন্তু এরই মধ্যে হত্যাকান্ডটি ঘটে গেল । স্থানীয় নেতৃবৃন্দও এই ঘটনাকে নিন্দা করে বলেছেন, “মাদক একটা সমস্যা, কিন্তু নিজের হাতে বিচার করা কোনো সমাধান নয়। এটা আমাদের সামাজিক কাঠামোকে দুর্বল করে। তবে অবগত হওয়ার পরে প্রশাসন যথাসময়ে উপস্থিত হলে হয়তো এই হত্যাকান্ডটি ঘটত না।
” তারাগঞ্জ থানা পুলিশ দেরিতে পৌঁছার ব্যাপারে জানতে চাইলে ওসি এম এ ফারুক বলেন, ” আমার ফোর্স দ্রুততার সাথে ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে । হাজার হাজার জনতাকে বোঝাতে একটু সময় লেগেছে । আমরা ঘটনার তদন্ত শুরু করেছি। মিথ্যা অপপ্রচার ছড়ানোদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অপরাধীদের কোন ছাড় দেওয়া হবেনা । ঘটনার পর এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে, এবং পুলিশ ও আর্মির অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে । এই ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে আমরা নিজেরাই অমানুষ হয়ে উঠছি না তো?