“অভিযোগ উঠেছে, হাসপাতালের ভেতরে অবৈধভাবে এম্বুলেন্স পার্কিং গড়ে তোলা, এম্বুলেন্সের সিরিয়াল নিয়ন্ত্রণ, হাসপাতাল পয়েন্টের সড়কের ফুটপাত দখল করে অবৈধভাবে দোকানপাট নির্মাণ ও এসব দোকানপাট থেকে নিয়মিত ভাড়া বাবত চাঁদা উত্তোলন করার। তবে তাঁকে গ্রেফতার করলেও বর্তমানে এসব নিয়ন্ত্রণ করছেন তাঁর সিন্ডিকেটের সদস্যরা।”
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি:
সুনামগঞ্জে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলা ও গুলির ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় জেলা সদর হাসপাতাল পয়েন্টের ত্রাস হিসেবে পরিচিত মো: নুরুল মিয়াকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। নুরুল মিয়া শহরের পূর্ব সুলতানপুরের মো: আবিদ আলীর ছেলে। গেল ৪ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলা ও গুলির ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় তাকে এজহারনামীয় আসামি হিসেবে গত শুক্রবার (৯ মে) রাতে হাসপাতাল পয়েন্ট থেকে তাকে গ্রেফতার করে সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানা পুলিশ।
গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করে সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো: আবুল কালাম বলেন, গত ৪ আগস্টে সুনামগঞ্জে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলা ও গুলির ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় এজহারনামীয় আসামি নুরুল মিয়া। তাকে ডেভিল হান্ট অভিযানে গ্রেফতার করা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নুরুল মিয়া দীর্ঘদিন ধরে সুনামগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেলা সদর হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ফটকের দুই পাশের সড়কের ফুটপাত দখল করে অবৈধভাবে দোকানপাট স্থাপন করে নিয়মিত ঐসব দোকান থেকে চাঁদা উত্তোলন করে আসছেন। সেখানে তাঁর নেতৃত্বে গত সাপ্তাহে নতুন করে আরও একটি অস্থায়ী দোকানঘর নির্মাণ করা হয়েছে। যদিও বেশকিছু দিন আগে জেলা প্রশাসন ও পৌরসভা কর্তৃক অভিযান চালিয়ে এসব স্থাপনা উচ্ছেদ করে ফুটপাত দখল মুক্ত করে। তবে, উচ্ছেদের কিছুদিন পরপরই আবার তাঁর নেতৃত্বে পুনরায় স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। হাসপাতাল কেন্দ্রিক নুরুল সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় প্রশাসনও।
এছাড়াও, স্থানীয় প্রভাব খাটিয়ে হাসপাতাল চত্বরে জমি দখল করে অবৈধভাবে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স পার্কিং গড়ে তুলেছেন তিনি। তার নেতৃত্বেই এসব অ্যাম্বুলেন্সের সিরিয়াল নিয়ন্ত্রণ করা হতো। পরে সিরিয়াল নিয়ন্ত্রণের নামে এম্বুলেন্স চালক-মালিকদের কাছ থেকে প্রতিদিন মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিতেন নুরুল ও তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা। যদিও হাসপাতালের ভেতরে বেসরকারি এম্বুলেন্স পার্কিং অবৈধ বলে স্বীকার করেছেন বেশ কয়েকজন চালকও। আর হাসপাতালে পার্কিং করা অধিকাংশই নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে মাইক্রোবাস থেকে অ্যাম্বুলেন্সে রূপান্তরিত করা হয়েছে। হাসপাতালে আসা রোগীদের এসব নড়বড় এম্বুলেন্স দিয়েই ব্ল্যাকমেইল করে ইচ্ছে মতো টাকা আদায় করেন তাঁরা। আর বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স গুলোর ‘অবৈধ পার্কিংয়ে’র ফলে হাসপাতালে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের পড়তে হচ্ছে চরম ভোগান্তিতে। নুরুল মিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন সময়ে অনৈতিক সুযোগ সুবিধা নেওয়ার জন্য হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসকদের হুমকি দেয়ারও। আছে, হাসপাতাল কেন্দ্রিক বিভিন্ন ধরনের টেন্ডার বাণিজ্যের অভিযোগও। ফেইসবুকে ব্যক্তিগত আইডিতে নুরুল মিয়াকে সুনামগঞ্জ জেলা জাতীয় পার্টির সদস্য সচিব এডভোকেট মো: নাজমুল হুদা হিমেল এর একাধিক পোস্ট শেয়ার করতে দেখা যায়। একই সাথে জাতীয় পার্টির এই নেতার সাথে তাঁর একাধিক ছবিও পাওয়া গেছে ফেইসবুকে।
এদিকে, নুরুল সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে ব্যপক ভাবে পরিচিত স্থানীয় বাসিন্দা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জহির আলী। তাঁর বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত শিক্ষার্থীদের তৎকালীন সময়ে সদর হাসপাতালে চিকিৎসায় বাধা দেওয়ার। জহির আলী সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম আহবায়ক।
এর আগে, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জহির আলীর নেতৃত্বে চুক্তি ভিত্তিক চাকরির (আউটসোর্সিং) মেয়াদ শেষ হওয়ার পর চাকরি পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন হয়েছে। তবে, আইনীভাবে চাকরি পুনর্বহালের সুযোগ না থাকায় ঐসময় দাবি মানতে পারেন নি কতৃর্পক্ষ। এ কারণে গেল বছরের ২৫ আগস্ট বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করে তাঁর নেতৃত্বে হাসপাতালে হামলা ও ভাংচুর চালানো হয়। তালা মেরে বন্ধ করে দেয়া হয় হাসপাতালের বহির্বিভাগের চিকিৎসা সেবা। আর এই হামলা ও ভাংচুর চালানোর আড়ালে থাকা মূল নায়ক ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে মেডিকেল পয়েন্টের ত্রাস নুরুল মিয়ার বিরুদ্ধে।
স্থানীয়দের তথ্য মতে, জহির আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় কর্মী। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সভা—সমাবেশের সামনের কাতারের নেতা তিনি। ফেসবুকে ছিলেন ছাত্র আন্দোলনের তুখোড় সমালোচক। যদিও পাঁচ আগস্টের পর ফেসবুক থেকে সব মুছে দেন জহির।
অভিযোগ আছে, তৎকালীন সময়ে ওয়ার্ড বয় হয়েও ইমার্জেন্সি বিভাগে চিকিৎসা দিত জহির। বিনিময়ে কাজ শেষে রোগীদের কাছ থেকে আদায় করা হতো টাকা। বর্তমানেও স্থানীয় প্রভাব দেখিয়ে প্রতিনিয়ত সদর হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। সম্প্রতি চিকিৎসা দেয়ার কয়েকটি ছবিও আছে এই প্রতিবেদকের কাছে। স্থানীয় প্রভাবের ভয়ে এই নুরুল বাহিনী ও জহির আলীর বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পান না।
তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে রাজি নন স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা জহির আলী। এপর্যায়ে তিনি হাসপাতালে পেটের দায়ে চিকিৎসা সেবা দিয়ে তাঁকেন বলে মন্তব্য করেন।
নুরুল মিয়ার গ্রেফতারের খবরে স্থানীয়দের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। তাদের ভাষ্য, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা হাসপাতাল এলাকার এই নৈরাজ্য এবার কিছুটা হলেও কমবে । তবে, তাঁর সিন্ডিকেট বাহিনীর অন্যতম সদস্য স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা জহির আলীসহ অন্যান্যের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান স্থানীয়রা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যক্তি জানান, নুরুল বাহিনীর কাছে মেডিকেল পয়েন্টের সবাই অসহায়। তাঁদের নেতৃত্বে হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ফটকের সামনের সড়কের দুই পাশে ফুটপাত দখল করে দোকানপাট তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া তাঁর নেতৃত্বেই চলে এখানকার এম্বুলেন্স সেবা, সিরিয়াল নিয়ন্ত্রণ ও ভাড়া নির্ধারণ। তাছাড়া, ঐসব দোকান থেকে ভাড়ার নাম করে প্রতিনিয়তই চাঁদা উত্তোলন করতেন তিনি।
তাদের মতে, নুরুলকে ছাত্রজনতার উপর হামলার অভিযোগে গ্রেফতার করায় আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে তাঁর সিন্ডিকেটের সদস্যরা। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা জহির আলীও এই সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত।
সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো: আবুল কালাম বলেন, গত ৪ আগস্টে সুনামগঞ্জে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলা ও গুলির ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় এজহারনামীয় আসামি ছিলেন নুরুল মিয়া। তাকে গত শুক্রবার রাতে মেডিকেল পয়েন্ট থেকে ডেভিল হান্ট অভিযানে গ্রেফতার করা হয়। বর্তমানে নুরুল কারাগারে আছেন বলে জানান এই কর্মকর্তা।
উল্লেখ্য, সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এম.এ মান্নান, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল হুদা মুকুট সহ সুনামগঞ্জের সাবেক চার এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সহ মোট ৯৯ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ২০০ জনকে আসামি করে সুনামগঞ্জে ২ সেপ্টেম্বর দ্রুত বিচার আইনে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্টেট নির্জন কুমার মিত্র’র আদালতে ঐ মামলাটি দায়ের করেন জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার লক্ষীপুর ইউনিয়নের এরোয়াখাই গ্রামের মো.হাফিজ আহমদ। তিনি ঐ গ্রামের মো. নাজির আহমদের ছেলে।