স্বৈরাচার পতনের একদফা দাবিতে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে রাজধানীর মিরপুরে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর সংঘর্ষে ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট শহীদ হন মিরপুর সেনপাড়া ইসলামিয়া হাইস্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. মিরাজ।
মিরাজের বাবা মাকছুদ ফরাজি সন্তানের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ছেলেটা আমার ছোটবেলা থেকেই খুব নম্র, ভদ্র, শান্ত স্বভাবের ছিল। পরীক্ষার ফলাফলের বাইরেও যথেষ্ট মেধাবী ছিল মিরাজ। বাসায় খুব একটা পড়াশোনা করত না। পড়ালেখার বাইরের বিভিন্ন কাজকর্ম নিয়েই ব্যস্ত থাকত। ওর একটি কালো পোষা বিড়াল ছিল।
বাবার কষ্ট ঘুচানো হলো না
স্মৃতি হাতড়ে মিরাজের বাবা বলেন, আমি দিনমজুরের কাজ করি। মিরাজ আমাকে মাঝে মাঝে বলত, আমি পাড়া লেখা শেষে যখন চাকরি করব, তখন তোমাদের আর কষ্ট থাকবে না। কিন্তু মিরাজ আগেই না ফেরার দেশে চলে গেল, আমার কষ্ট রয়েই গেল। ওর মা সব সময় কান্নাকাটি করে।
রাজধানীর মিরপুরের ৬ নং ওয়ার্ডের সেনপাড়ার বাসায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস-এর প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ মিরাজের (১৮) বাবা মাকছুদ ফরাজি এসব কথা জানান।
মিরাজের গ্রামের বাড়ি ভোলা সদর উপজেলার ৭ নং ওয়ার্ড। মিরাজের বাবা দিনমজুর মাকছুদ ফরাজি (৪৫) ও মা মিনারা বেগম (৩৬)। মিনারা বেগম বাসা বাড়িতে কাজ করেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে মিরাজ ছিলেন সবার বড়। মেঝ ভাই রায়হান ফরাজি (১৭) ইসলামিয়া হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণিতে আর ছোট ভাই আশরাফুল ফরাজি ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ছে।
জানা যায়, মিরাজ ৪ আগস্ট বেলা ২ টা ৩০ মিনিটের দিকে গুলিবিদ্ধ হয়। দুইটি গুলিই মিরাজের পেটে লাগে। উপস্থিত ছাত্র-জনতা স্থানীয় আজমত মেডিকেলে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পরে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে একটি ট্রাক ভাড়া করে মিরাজের লাশ নিয়ে পরিবারের সবাই ভোলায় চলে যান। সকাল সাড়ে ৫ টার দিকে নিজ বাড়িতে পৌঁছেন তারা। পরে জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
মিরাজের বাবা বলেন, মিরাজের লাশ হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে এসে গোসল করাই। এরপর লাশ বাসার সামনে রাখি। তখন লাশ দেখতে হাজার হাজার মানুষ এসে জমায়েত হয়।
এলাকা ছাড়ার হুমকি
সেই সময়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা এসে আমাকে এলাকা ছাড়তে হুমকি দেন। বলেন, ‘ছেলে মারা গেছে তিন দিন শোক পালন করবি, এর পর এলাকা ছেড়ে চলে যাবি। না হলে তোর সদস্যা হয়ে যাবে।’
তিনি বলেন, এই চিন্তার মধ্যেই মিরাজের লাশ নিয়ে আমরা গ্রামে চলে যাই এবং জানাজা শেষে দাফন করি। এর কিছু সময় পরেই খবর পাই স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এই খবর শুনে মনে একটু স্বস্তি আসে। মনে আশা জাগে, আমি পরিবার নিয়ে ঢাকায় ফিরতে পারব।
তিনদিন পরে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল শেষ করে ঢাকা ফিরে আসি। যারা আমার পরিবারকে এলাকা ছাড়তে হুমকি দিয়েছিল তারাই এখন এলাকা ছাড়া হয়েছে।
মা-বাবার অগোচরে আন্দোলনে
৪ আগস্টের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে শহীদ মিরাজের বাবা বলেন, মিরাজ আগে থেকেই প্রতিদিন আন্দোলনে যেত। আমি ওকে নিষেধ করতাম। বলতাম, আমরা গরিব মানুষ তোমার আন্দোলনে যাওয়ার দরকার নেই। আন্দোলন করে কী হবে? কিন্তু আমি দিনমজুরের কাজ করি। ওর মা বাসাবাড়িতে কাজ করে। আমরা যেহেতু বাসায় কেউ থাকতাম না, সে স্কুল শেষে আন্দোলনে যেত। আমরা এটা জানতাম না।
তিনি বলেন, ৪ আগস্ট আমি সকালে বাসায় ছিলাম। মিরাজ ওই দিন সকাল ৯ টার দিকে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা খেয়ে ১০ টার দিকে বাইরে যায়। সে যখন বাসা থেকে বের হয়, তখন আমি ওকে বাইরে যেতে নিষেধ করি। সে বলেছিল, স্কুলের সামনে থেকে চা খেয়েই চলে আসবে।
তিনি বলেন, একটু পরে কাজে বাইরে চলে যাই। আমি মিরাজের আর কোনো খবর নিতে পারি নাই। পরে ৩ টার দিকে আমার ফোনে একটা কল আসে, বলে মিরাজ গুলি খেয়েছে। পরে আমি আজমত হাসপাতালে গিয়ে দেখি ছেলে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, না ফেরার দেশে।
নিদারুণ কষ্টের সংসার
সরেজমিনে রাজধানীর মিরপুর- ৬ নম্বরের ‘ট’ ব্লকে মিরাজের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, নিচ তলায় একটি একরুমের বাসায় ভাড়া থাকতেন শহীদ মিরাজের পরিবার। খালের ওপর কাঠের পাটাতন দিয়ে তৈরি সারি সারি রুম। এর মধ্যে একটি রুমে ভাড়া থাকেন মিরাজের ৫ সদস্যের পরিবার।
সেখানে কোনো স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নেই। রুমের মধ্যেই রান্না করে খেতে হয়। একটি অন্ধকার রুমেই থাকে পরিবারটি। রুমে তেমন কোনো আলো-বাতাস প্রবেশের পথ নেই। স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। তেমন কোনো আসবাপত্রও নেই। বাসার অবস্থা দেখলেই বোঝা যায় কী নিদারুণ কষ্টে সংসার চালছে তাদের।
সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার
শহীদ মিরাজের মা মিনারা বেগম বলেন, ছেলেডারে নিয়ে আমার তো অনেক আশা ছিল, ছেলে চাকুরী করে সংসার চালাবে। আমাদের অভাব-অনটন দূর করবে। সে ইচ্ছা যে, এভাবে শেষ হয়ে যাবে, তা কে জানত। এখন আমি কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবো। আমার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।
ছোট ভাই রাহায়ন ফারাজি বলেন, বড়ভাইকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। পরিবারের সবার ইচ্ছে ছিল ভাই বড় হয়ে মা-বাবার সব স্বপ্ন পূরণ করবে।
সরকার যদি আমাদের দিকে তাকায়, তাহলে আমরা ভালভাবে বাঁচতে পারবো। আমরা দুইভাই পড়াশোনা চালাতে পারবো। আব্বু ও আম্মু যে টাকা আয় রোজগার করেন তা দিয়ে আমাদের সংসার চলে না। আমার ভাইকে যারা গুলি করে হত্যা করেছে তাদের কঠিন বিচার চাই, তাদের ফাঁসি চাই।
রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদের মর্যাদা চান মা
শহীদ মিরাজের মা মিনারা বেগম বলেন, আমাদের অল্প আয়ের সংসার। ওর বাবা আগে দিনমজুরের কাজ করতো, ছেলে শহীদ হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন স্থানে দৌঁড়াতে হয়, এখন ঠিক মত কাজ করতে পারে না। আর আমি বাসা বাড়িতে কাজ করে যা টাকা পাইতাম তা দিয়েই আমাদের সংসার চলত।
সরকার যদি আমাদের পাশে দাঁড়ায় তাহলে আমাদের পরিবারটা একটু ভালোভাবে বাঁচতে পারবে। আমার ছেলেকে যারা হত্যা করেছে আমি তাদের বিচার চাই। আমার ছেলে তো দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। তাকে যেন শহীদের মর্যাদা দেয়া হয়।
নিহতদের শহীদের মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানিয়ে মিরাজের বাবা বলেন, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে যারা নিহত হয়েছেন, তাদের সবাইকে যেন শহীদের মর্যাদা দেওয়া হয়। শুধু মুখে শহীদ বললে হবে না। রাষ্ট্রীয়ভাবে সবাইকে শহীদের মর্যাদা দিতে হবে।
সহযোগিতা ও পুনর্বাসনের দাবি
একই সাথে এই আন্দোলনে সারাদেশের যে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা আহত হয়েছেন তাদের পুনর্বাসনের দাবি জানান শহীদ মিরাজের বাবা।
কারো কাছ থেকে কোন সহযোগিতা পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে মাকছুদ ফরাজি বলেন, জুলাই ফাইন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকার চেক ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা পেয়েছি।
প্রতিবেশি রফিকুল ইসলাম জানান, মিরাজ অনেক ভালো ছেলে ছিল। সে যে এভাবে গুলিতে মারা যাবে আমরা মেনেই নিতে পারছি না। ওর মৃত্যুর খবর শুনে আমি খুবই মর্মাহত হই। সরকারের কাছে দাবি মিরাজের পরিবার যেন চলতে পারে এমন একটা ব্যবস্থা করে দিক।
মিরাজ শহীদ হওয়ার ঘটনায় প্রায় দুই মাস পরে বাবা মাকছুদ ফরাজি ১৪ জনের নামে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।