একটি সমাজের মূল ভিত্তি পরিবার। ঐতিহ্য, মূল্যবোধ ও শৃঙ্খলার প্রধান শিক্ষালয় হলো পরিবার। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আজ আমরা এক ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি। পারিবারিক বন্ধন শিথিল হচ্ছে, সন্তানদের মাঝে মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধা কমে যাচ্ছে, এবং প্রযুক্তির অতিমাত্রায় ব্যবহার আমাদের সমাজকে বদলে দিচ্ছে এক জটিল বাস্তবতায়।
আমাদের আগের প্রজন্মের অভিজ্ঞতা একদম ভিন্ন ছিল। তখন সকালের শুরু হতো মক্তব বা মাদ্রাসায় কুরআন শেখার মাধ্যমে। দুপুরে গরম ভাত খেয়ে বিকেলে মাঠে খেলাধুলা ছিল স্বাভাবিক রুটিন। মা-বাবার শাসন ছিল কঠোর, কিন্তু সেই শাসন ভালোবাসারই অন্যরূপ। সেই সময়ের অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে ভোরে উঠে পড়াশোনা করত, বড়দের সম্মান করত, এবং পারিবারিক বন্ধনের মধ্যে বড় হতো।
কিন্তু বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় এসব দৃশ্য কল্পনাই করা যায় না। এখন শিশুদের হাতে ছোটবেলা থেকেই স্মার্টফোন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ফলে পরিবারিক বিনোদন বলে কিছু থাকে না, সবাই আলাদা জগতে বন্দী হয়ে যায়। প্রযুক্তির ইতিবাচক দিক যেমন আছে, তেমনি এর অতি ব্যবহার আমাদের সন্তানদের মূল্যবোধের জায়গায় এক গভীর শূন্যতা তৈরি করছে।
সন্তানদের সাফল্যকে কেবল সার্টিফিকেট আর প্রতিযোগিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি আমরা। ছোটদের শৈশব কেড়ে নিয়ে কোচিং আর প্রাইভেট টিউশনির চাপে পিষ্ট করা হচ্ছে। অথচ, প্রকৃত শিক্ষার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও দেশপ্রেম গড়ে তোলা। অথচ, এখনকার শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিকতা শেখানোর চেয়ে মুখস্থবিদ্যার প্রতিযোগিতাই বেশি। শিক্ষকেরা এখন আর ছাত্রদের শাসন করার অধিকার রাখেন না। ফলে দেখা যায়, শিক্ষকেরা অপমানিত হন, হেনস্তার শিকার হন। অথচ একসময় মা-বাবারা শিক্ষকদের বলতেন, “স্যার, মাংস আপনার, হাড় আমার” অর্থাৎ, সন্তান মানুষ করার দায়িত্ব আপনাদের।
পারিবারিক বন্ধন শিথিল হওয়ার আরেকটি বড় কারণ হলো পরিবারের সদস্যদের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। এখন অনেক পরিবারই চাকরি বা ব্যবসার কারণে আলাদা থাকে। ফলে সন্তানদের দাদা-দাদী, নানা-নানী, চাচা-মামাদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় না। আমরা নিজেরাই সন্তানদের শেখাই কে ভালো, কে খারাপ। ফলে পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে যায়। আজকের বাস্তবতায় দেখা যায়, বৃদ্ধাশ্রমে মা-বাবাদের ঠেলে দেওয়ার চিন্তাও অনেক সন্তানের কাছে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। অথচ, এই প্রবণতা আমাদের সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
আমাদের এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কিছু পদক্ষেপ জরুরি—
১. **পারিবারিক সময় বাড়াতে হবে**: সন্তানদের সঙ্গে নিয়মিত সময় কাটানো জরুরি। একসঙ্গে খাওয়া, গল্প করা, ঘুরতে যাওয়া— এসব তাদের মানসিক বিকাশে সহায়ক।
2. **শিশুদের নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে**: ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ শিশুদের ছোটবেলা থেকেই শেখানো উচিত।
3. **প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে**: স্মার্টফোন বা ইন্টারনেট ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ রাখা জরুরি।
4. **শিক্ষকদের সম্মান ফিরিয়ে আনতে হবে**: শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা ফিরিয়ে আনতে হবে এবং শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান নিশ্চিত করতে হবে।
5. **পারিবারিক বন্ধন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে**: দাদা-দাদী, নানা-নানীসহ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে।
আমরা যদি এখনই সচেতন না হই, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এক ভয়ংকর শূন্যতায় হারিয়ে যাবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক পথে চলার তৌফিক দান করুন।
**ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম**
চেয়ারম্যান, আলহাজ্ব কে.এম. আব্দুল কারীম রাহিমাহুল্লাহ ট্রাস্ট