জবি প্রতিনিধি
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) এর ক্লাসে নবীন শিক্ষার্থীদের মানসিক ভাবে হেনস্তা করার অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক সৌম্য সরকার এবং ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের কৌশিক দত্তের বিরুদ্ধে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঠেছে সমালোচনার ঝড়।
জানা যায়, প্রথম ঘটনাটি ঘটে ২৯ অক্টোবর রোজ মঙ্গলবারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে নবীন ব্যাচের ক্লাস চলাকালীন সৌম্য সরকার নামক এক শিক্ষক ক্লাসে আগমন করে শিক্ষার্থীদের আদেশ দেন যেন, ক্লাসরুমে উপস্থিত ছেলে এবং মেয়ে শিক্ষার্থীরা যেন নিজেদের পৃথক বসার জায়গা থেকে সরে একসাথে মিলে বসে। এসময় তিনি হুমকি দেন যে, শিক্ষার্থীরা এই আদেশ না মানলে উনি ক্লাস নিবেন না।
একইভাবে, দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে ৩০ অক্টোবর রোজ বুধবারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুগোল ও পরিবেশ বিভাগের ১৭ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী কৌশিক দত্ত নতুন ১৯ তম ব্যাচের সবার সাথে কথা বলার নাম করে একটা রুমে ডেকে নেয়। শিক্ষার্থীরা রুমে ঢোকার সাথে সাথে ১৭ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী কৌশিক দত্ত সকল ছেলে-মেয়েকে আদেশ করে, ছেলেরা যেন মেয়েদের বেঞ্চে এবং মেয়েরা যেন ছেলেদের মাঝে গিয়ে বসে। এই আদেশ পালনের জন্য সকলকে সর্বোচ্চ ০২ মিনিট সময় দেওয়া হয়। আদেশ না মানলে শিক্ষার্থীদের ব্যাক্তিগতভাবে ক্ষতি করা হুমকি দেয়।
ঘটনার ভুক্তভোগী একজন নারী শিক্ষার্থী নাম-পরিচয় প্রকাশ না করা শর্তে জানান, ক্লাসে ১৭ ব্যাচের আরও কয়েকজন সিনিয়র ছিলো। তারা কৌশিক দত্তের নির্দেশের বিপক্ষে একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। বরং তারা কৌশিক দত্তের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদেরকে আরও তাড়াতাড়ি আসন পরিবর্তন করে মিলে বসার আদেশ দেয়।
এসময় আমি আমার আসন থেকে না সরলে, ওরা আমার পাশে সনাতন ধর্মাবলম্বী বিপরীত লিঙ্গের একজনকে এনে বসিয়ে দেয়। আমি খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরে যাই। আমাদের ব্যাচে আরও বোরকা পরিহিতা অনেক মেয়ে ছিল। তারা এসময় মারাত্মক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে গিয়ে পড়ে। তারা না পারছিলেন ছেলেদের পাশে বসতে, আর না পারছিলেন কিছু বলতে। এখানে আমাদের মূল্যবোধকে অপমান ও উপেক্ষা করা হয়েছে, আমাদেরকে মানসিক ভাবে হেনস্তা করা হয়েছে। আমরা এমনটা কখনোই আশা করিনি।
ইংরেজি বিভাগের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ১৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী রেজোয়ানুর রহমান জানান, সৌম্য স্যার ক্লাসে এসে আমাদের নিজেদের মধ্যে বন্ডিং বাড়ানো জন্য ছেলেমেয়ে একসাথে বসতে বলেন। তিনি আমাদের জোর করেননি। তবে আমি মনে করি এটা আমাদের ধর্মীয় অনুশাসনে বিরোধী। আমি ব্যক্তিগতভাবে ছেলেমেয়ে একসাথে বসাকে পছন্দ করিনা। কারণ আমার ধর্মীয় মূল্যবোধ আমাকে বাধা দেয়। ইসলামে এভাবে অবিবাহিত ছেলেমেয়ে একসাথে বসার অনুমতি নেই। আমি মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে চাই কিন্তু সেটা আমার ধর্মীয় মূল্যবোধকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে নয়।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক সৌম্য সরকারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেখুন, সামাজিক মাধ্যমে বিষয়টি ছড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি আমি শুনেছি (কারণ আমি ফেইসবুক ব্যবহার করি না)। আমার প্রাক্তন এক শিক্ষার্থী তার মত দিয়েছে। কেউ সেটার বিরোধিতা করেছে, কেউ আবার “অভিযোগ” সমর্থন করেছে। তারা তাদের মতো করে উন্মূক্ত ভাবে কথা বলছে, বলুক।
মুক্ত কথা বলাতেই আমি বিশ্বাস করি। আমার একটা শিক্ষাদর্শন আছে, সে অনুযায়ী আমি ক্লাসে বা ক্যাম্পাসে কাজ করি, যার যার সম্মানজনক অবস্থানকে মূল্য দিয়ে। ক্লাসের যে অরগ্যানিক আবহ থাকে সেখানেই সেটা বোধহয় বোঝা যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক বোঝাপড়াটা আমার কাছে জরুরি। বন্ধুসুলভতা তৈরি হয় এমন পরিবেশ তৈরি করাটা শিক্ষক হিসেবে দ্বায়িত্ব মনে করি। আপনার আরও কথা থাকলে সরাসরি কথা বলবেন আশা করি।
এই ঘটনার প্রতিবাদ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবাধিকার সংগঠন ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় হিউম্যান রাইটস সোসাইটি’ এক বিবৃবিবৃতি প্রকাশ করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আমরা বিশ্বাস করি, প্রগতিশীলতা কখনোই চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে অর্জন করা যায়না। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর অধিকার রয়েছে নিজেদের ব্যক্তিগত বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ অনুযায়ী চলার। তাদের নিজস্ব স্বাধীনতা ও সম্মান রক্ষা করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্যতম দায়িত্ব। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের উন্নত ও স্বাধীন চিন্তার বিকাশ ঘটানো বরং এটা নয় যে তাদের ওপর কোনো নির্দিষ্ট চিন্তাধারা কিংবা আচরণ চাপিয়ে দেওয়া।
আমরা দাবি করছি, শিক্ষার্থীদের মানবাধিকার ও মানসিক স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কার্যকর পদক্ষেপ নিক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আমাদের আহ্বান, তারা যেন এই ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করেন। এটি শিক্ষার্থীদের প্রতি সম্মান এবং একটি সমৃদ্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব হিসেবেই বিবেচিত হওয়া উচিত।